সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিই এখন আসল

Google Alert – সামরিক

বৈশ্বিক রাজনীতিতে ‘হার্ড পাওয়ার’ বা বলপ্রয়োগের যুগ আবার ফিরে এসেছে। এশিয়া থেকে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে আফ্রিকা—মহাদেশ জুড়ে আইন, নিয়ম এবং এমনকি জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলিও উপেক্ষা করা হচ্ছে। এখন যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সামরিক সক্ষমতা, অর্থনৈতিক পেশী এবং উভয়কে ব্যবহার করার সাহস।

বৈশ্বিক শাসনের উপর যে বিশ্বাস ছিল, তা এখন আর নেই। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে, যার পেছনে রয়েছে মার্কিন ডলার, মারাত্মক অস্ত্র এবং বারবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো। ইউক্রেন এবং রাশিয়া যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে উপসাগরীয় দেশগুলোর একজন মিত্র হিসেবে জাহির করলেও ভিন্নভাবে কাজ করে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতে, ওয়াশিংটন কাতারের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানত, তবুও তাদের বিলিওন-ডলারের চুক্তি-করা বন্ধুকে সতর্ক করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

এদিকে, পশ্চিমা বিশ্বও নিজেদের মধ্যে সংঘাতে রয়েছে। রাশিয়া নিয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভেদ রয়েছে এবং পশ্চিমা সমাজগুলো যা একসময় অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়েছিল, এখন তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে। একসময়ের শান্ত সমাজগুলো এখন বিস্ফোরক অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।

এই পরিবেশে ইরান, সৌদি আরব, ইরাক, কাতার, মিশর, লেবানন, ইয়েমেন এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ নিজেদেরকে বাইরের হুমকি, বিশেষত ইসরায়েলের বিপজ্জনক হুমকির মুখোমুখি দেখতে পাচ্ছে।আমেরিকার পর ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক আধিপত্য চায়ছে। কিন্তু মে মাসে মোদি-দোভাল বাহিনীর ক্ষমতা প্রদর্শনের নীতি মারাত্মক ধাক্কা খায়। ৭ মে পাকিস্তানের উপর ভারতের বেপরোয়া হামলা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়।

ইসলামাবাদ এই সুযোগটি কাজে লাগায়, একটি সমন্বিত বহু-ক্ষেত্রের প্রতিরক্ষা কৌশল, অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিমান শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রথমবারের মতো দেশীয় সাইবার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সক্ষমতা প্রদর্শন করে। পরের মাসে, ইসরায়েলের ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। তেহরানের প্রতি দেশটির দ্ব্যর্থহীন, স্পষ্টভাবে ঘোষিত কূটনৈতিক সমর্থন মুসলিম বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।

মে এবং জুনের যুদ্ধ দুটি একত্রে বাস্তবতাকে নিশ্চিত করেছে: বলপ্রয়োগের কৌশল বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং পাকিস্তান সামরিকভাবে শক্তিশালী ও কূটনৈতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য উভয় হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে।

এই পরিবর্তন পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত ভূমিকা এবং ফিল্ড মার্শাল সিওএএস অসীম মুনিরের সাথে সম্পর্কিত। তিনি “আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা” নীতি গ্রহণ করেছেন, যা পাকিস্তানের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রকৃতি পরিবর্তন করেছে।এই আক্রমণাত্মক-প্রতিরক্ষামূলক ক্ষমতা প্রদর্শনের নীতিতে কঠোর প্রশিক্ষণ, প্রচলিত এবং অপ্রচলিত উভয় ধরনের হুমকির জন্য প্রস্তুতি, এবং ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত বিষয়গুলির নিষ্পত্তির জন্য কেবল প্রতিরক্ষামূলকভাবে নয়, বরং শক্তি প্রয়োগের ইচ্ছাকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে কাশ্মীর। ফিলিস্তিনও রয়েছে, যেখানে পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে এবং প্রকাশ্যে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমানা এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের উপরও জোর দিয়েছে। চীন, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, মিশর এবং ওমানের সাথে সম্পর্ক এখনও দৃঢ় রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক সতর্কতার সাথে আবার গড়ে তোলা হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও আজারবাইজানের সাথে নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হচ্ছে। যৌথ প্রশিক্ষণ, প্রতিরক্ষা উৎপাদন এবং অস্ত্র রপ্তানি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে বিশ্বে দৃশ্যমান করে তুলেছে।ঐতিহাসিকভাবে, ইসলামাবাদের প্রধান অংশীদারিত্ব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সৌদি আরবের সাথে। অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক সম্পর্কের আগে নিরাপত্তা সম্পর্ক দিয়ে শুরু হয়েছিল এই অংশীদারিত্ব। সেই ধারা এখনও চলছে।

মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপস্থিতি কয়েক দশকের পুরনো, যা ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয়। সম্পর্কের ওঠানামা সত্ত্বেও, তা কখনও ভেঙে যায়নি। তিনটি ঘটনা — ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা, দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে তার সম্পর্ক — মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামাবাদের জড়িত থাকার গতিপথকে আকার দিয়েছে।১৯ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তান ও সৌদি আরব যখন স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট (এসএমডিএ) স্বাক্ষর করে, তখন সেই ইতিহাস পূর্ণতা পায়। এর কেন্দ্রীয় ধারাটি স্পষ্ট: “একটি দেশের উপর আক্রমণকে উভয়ের উপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হবে”।

পাকিস্তানের জন্য এটি একটি কৌশলগত উল্লম্ফন। এটি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তায় দেশটির আগের উচ্চ-প্রোফাইল ভূমিকা পুনরুদ্ধার করেছে। প্রাথমিক লক্ষণগুলি আশাব্যঞ্জক: কাতার, মিশর এবং তুরস্ক ইতিমধ্যেই ইসলামাবাদের সাথে অনুরূপ চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে‌ উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার কাতারের সভাপতিত্বে একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রিত ছিলেন। এই দৃশ্য সেই দিনগুলি থেকে বেশি দূরে নয় যখন আরব রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানকে গাজার বিষয়ে কূটনৈতিকভাবে খুব বেশি সক্রিয় না হওয়ার অনুরোধ করত। সৌদি আরবের জন্য‌ এর সুবিধাগুলিও স্পষ্ট। এটি তার নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করেছে, কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর না থেকে। এবার রিয়াদের সঙ্গী একটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তান, যার কৌশলগত সক্ষমতা প্রমাণিত।

এসডিএমএ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উত্থাপন করে। প্রথমত, পাকিস্তান কি সৌদি আরবকে পারমাণবিক নিরাপত্তা দেবে? ইসলামাবাদের আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা নীতি এবং ইসরায়েলের বারবার আগ্রাসনের কারণে, উত্তরটি সম্ভবত হ্যাঁ। কিন্তু আপাতত, কৌশলগত সংবেদনশীলতার কারণে, এটি এমন একটি উত্তর যা উভয় পক্ষ থেকে স্পষ্ট পাওয়া যাবে না।

দ্বিতীয়ত, এটি কি মার্কিন-সৌদি প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে প্রতিস্থাপন করবে? না। এটি সেগুলোকে পরিপূরক করবে, যা রিয়াদকে আমেরিকান সমর্থন বজায় রেখে আরও বিকল্প শক্তি দেবে। তৃতীয়ত, এটি কি পাকিস্তানকে কেন্দ্রে রেখে একটি আঞ্চলিক সামরিক জোটের বীজ হতে পারে? সম্ভবত। এই অঞ্চলের হুমকির পরিবেশ এটিকে আরও বেশি সম্ভব করে তোলে।

চতুর্থত, ওয়াশিংটন কি অনুমোদন দিয়েছে? রিয়াদ এবং ইসলামাবাদ উভয়ই ওয়াশিংটন, তেহরান এবং বেইজিংকে অবহিত করেছে বলে মনে হচ্ছে। সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেন্টকম-এর প্রধানের পাশাপাশি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে বৈঠকের পর টুইট করেছেন।

পাকিস্তানও সকল প্রধান পক্ষকে অবহিত করেছে। পঞ্চম, চীনের ভূমিকা কী? যদিও এখনও আনুষ্ঠানিক হয়নি, এটিকে উপেক্ষা করা কঠিন হবে। পাকিস্তান এবং সৌদি আরব উভয়ের সাথেই গভীর সম্পর্ক এবং চীনের অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির কারণে বেইজিং এই বিকশিত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একজন অংশীদার হওয়ার জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত।

বিশ্ব আবার বলপ্রয়োগের কৌশলে পরিবর্তিত হচ্ছে। ইসরায়েলের লাগামহীন আগ্রাসন, ভারতের ব্যর্থ ঔদ্ধত্য, নির্লজ্জ দ্বৈত নীতি এবং ইউরোপের বিভাজন সবই সেই বাস্তবতা তুলে ধরে।পাকিস্তানের জন্য এই অশান্ত পরিবেশ একটি নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। সামরিকভাবে, এটি পরিশীলিততা এবং সংকল্প প্রদর্শন করেছে। কূটনৈতিকভাবে, এটি আত্মবিশ্বাস এবং স্পষ্টতা দেখিয়েছে।

পাকিস্তান-সৌদি এসএমডিএ-এর মাধ্যমে ইসলামাবাদ মধ্যপ্রাচ্যে একটি ছোট অংশীদার হিসেবে নয়, বরং একটি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে পুনরায় যাত্রা শুরু করেছে। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের সংযোগস্থলে এটি পাকিস্তানের পুনরুত্থান। সূত্রঃ জিও টিভি 

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *