Google Alert – সামরিক
গত কয়েক দশকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) পদটি অনেক দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের নিকটতম ও গুরুত্বপূর্ণ সহকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক বিরোধসংক্রান্ত বিষয়ে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পদটি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে আরো সমন্বিত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ যখন সাইবার ঝুঁকি থেকে শুরু করে আঞ্চলিক অস্থিরতা পর্যন্ত বিবিধ নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি, তখন এ লেখক ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের পর পরই সরকার ও সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে এ পদ সৃষ্টির জন্য জোরালোভাবে মত প্রকাশ করেন।
সম্প্রতি এ পদে একজন বেসামরিক পটভূমির ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার কারণে বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। যখন দেশের সেনাবাহিনী প্রধান সরকারি সফরে রাশিয়ায় অবস্থান করছিলেন, তখনই অন্তর্বর্তী সরকার দুটি ঘোষণা দেয়: এক. বাংলাদেশে এনএসএ পদ সৃষ্টির ঘোষণা এবং দুই. এই শক্তিশালী ও সংবেদনশীল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—পদটি অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার জন্য উপযুক্ত, নাকি আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন দক্ষ বেসামরিক ব্যক্তির জন্য? এ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় আমরা এনএসএ পদের দায়িত্ব ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা তুলে ধরব এবং এ বিশ্লেষণেই বেরিয়ে আসবে, কোন পটভূমির ব্যক্তি এ পদে অধিক উপযুক্ত।
এনএসএর দায়িত্ব: জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। এনএসএ প্রধানত সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। তিনি সরকারের নিরাপত্তা কর্মসূচি ও তার বাস্তবায়নের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এনএসএ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কার্যকর কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারপ্রধানকে সহায়তা করেন।
এনএসএর প্রধান কাজ হলো দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে সহায়তা করা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণের পাশাপাশি, পররাষ্ট্রনীতি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, সন্ত্রাসবাদ, সাইবার হামলা, জ্বালানি সংকট ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়েও তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এনএসএ দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার সার্বিক তত্ত্বাবধানে, আন্তর্জাতিক বিরোধ সমাধানে এবং ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে সহায়ক উপদেশ প্রদান।
এনএসএ পদের জন্য প্রাসঙ্গিক দক্ষতা: এনএসএর মধ্যে যেসব দক্ষতা থাকা প্রয়োজন তার মধ্যে আছে—
নেতৃত্বগুণ: এনএসএকে হতে হবে বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণসম্পন্ন, যিনি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উদ্দীপনা সঞ্চার করতে পারবেন এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
বিশ্লেষণ ক্ষমতা: জটিল তথ্য বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শিতা প্রয়োজন। এনএসএকে একটি বহুবিধ ক্ষেত্রজ্ঞানসম্পন্ন দল পরিচালনা করতে হয়।
যোগাযোগ দক্ষতা: রাষ্ট্রপ্রধানকে স্পষ্টভাবে কৌশল ও পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে এবং বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় পারদর্শী হতে হবে।
আলোচনা ও সমঝোতার ক্ষমতা: সংকটময় সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এমন সামর্থ্য জরুরি।
ভূরাজনৈতিক সচেতনতা: সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে আপডেট থাকা এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষমতা।
যুক্তিনির্ভর চিন্তাশক্তি: পররাষ্ট্রনীতি, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষমতা।
রাজনৈতিক নিয়োগ ও আস্থার বিষয়: বিশ্বজুড়ে এনএসএ একটি রাজনৈতিক নিয়োগ হিসেবে বিবেচিত। সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই এ পদে নিয়োগ দেন এবং সরাসরি তার কাছে এনএসএ রিপোর্ট করে থাকেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতবর্ষে এনএসএ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এনএসএ নিয়োগ দেন। চীনে এনএসএ রাষ্ট্রীয় পরিষদের অংশ, যেখান থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। এ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধানের সর্বোচ্চ আস্থা অর্জন করতে হয়। কারণ এনএসএই নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সংকটকালীন সময়ের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।
সামরিক বনাম বেসামরিক: কে উপযুক্ত?
বাংলাদেশে বর্তমানে আলোচনা চলছে—এনএসএ হওয়ার জন্য সামরিক না বেসামরিক, কে উপযুক্ত? এক্ষেত্রে একক কোনো উত্তর নেই। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে, উভয় পটভূমির ব্যক্তিরাই এনএসএ পদে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এনএসএ ছিলেন রবার্ট কাটলার, যিনি সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে দায়িত্ব পালন করেন। জেক সুলিভান, হেনরি কিসিঞ্জার, জ্বিগনিউ ব্রেজিনস্কি, কন্ডোলিজা রাইস প্রমুখ এনএসএ ছিলেন মূলত বেসামরিক পটভূমির কূটনীতিক বা শিক্ষাবিদ।
যুক্তরাজ্যে ২০২৪ সালে জেনারেল গুইন জেনকিনস এনএসএ নিযুক্ত হয়েছেন, যিনি পেশাগতভাবে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। এর আগে এ পদে ছিলেন স্যার টিম ব্যারো, যিনি ছিলেন একজন কূটনীতিক। পাকিস্তানে ২০২৪ সালের এপ্রিলে আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম মালিক এনএসএ হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। তার আগের এনএসএ মঈদ ইউসুফ ছিলেন একজন একাডেমিশিয়ান।
অন্যান্য উদাহরণ হিসেবে কানাডায় জন প্রশাসক জোডি থমাস, ভারতে সাবেক গোয়েন্দা প্রধান অজিত ডোভাল, সৌদিতে জাতীয় পরামর্শক মুসায়েদ আল আয়বান এবং ইউএই-তে রাজপরিবারের সদস্য তাহনুন বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এনএসএ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
জনমত কী বলে: বাংলাদেশী কূটনীতিক, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্য থেকে মতামত নেয়া হয়েছে—কারা এনএসএ পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য অধিকতর উপযুক্ত বলে তারা মনে করেন। নিচের ছকে তাদের মতামত উপস্থাপন করা হয়েছে:
অবাক করার মতো বিষয় হলো—প্রতিটি শ্রেণীর উত্তরদাতার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই চাচ্ছেন, তাদের পেশাজীবী ক্ষেত্র থেকেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার (এনএসএ) পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হোক। অর্থাৎ তারা মনে করেন এনএসএ পদে তাদের পেশাগত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। তবে প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব যুক্তি রয়েছে, যার ভিত্তিতে তারা নিজেদের মতামতকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। নিচে দুটি মন্তব্য উপস্থাপন করা হলো:
‘একটা বিষয় যোগ করি, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদেরও এ ধরনের দক্ষতা রয়েছে—অনেক সময় হয়তো আরো বেশি। কারণ তাদের রয়েছে বাস্তবমুখী (অন-গ্রাউন্ড) বিশাল অভিজ্ঞতা। আমাকে বিশ্বাস করুন…’ (একজন কর্মরত দুই তারকা জেনারেল)
‘আমি জানতে চাই, এ অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি গত পাঁচ-আট বছরে কী করছিলেন? তিনি তো ১০ বছর আগে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। বেসামরিক ব্যক্তি—যিনি ২৫ বছর আগে বিজনেস বা ইকোনমিকসে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছেন, অথবা যিনি একজন কূটনীতিক ছিলেন এবং কোনো আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করেছেন—এগুলো আমার কাছে অর্থহীন। তার থাকতে হবে সমসাময়িক ভূরাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক বাস্তব অভিজ্ঞতা আমি জানতে চাই, তিনি (অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি) গত কয়েক বছর কী করেছেন।’— (একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশী)
দুটি মন্তব্যই স্পষ্ট ও যৌক্তিক এবং উভয় দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য। নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশের এমন অনেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা দক্ষতার সঙ্গে এনএসএর দায়িত্ব পালনের জন্য সক্ষম। তার ওপর তাদের রয়েছে মাঠ পর্যায়ের ব্যাপক বাস্তব অভিজ্ঞতা (যুদ্ধ অভিজ্ঞতা)। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য প্রবাসীর মন্তব্যটিও গুরুত্বপূর্ণ—তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, কূটনীতিক, একাডেমিক অথবা সামরিক কর্মকর্তা অবসরের পর কী করছেন? যদি কেউ অবসর নিয়ে পাঁচ বছর শুধু বিশ্রামেই কাটিয়ে দেন, তাহলে তিনি কীভাবে জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশল নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন? অবসরের পরও তাকে সমাজের কল্যাণে সক্রিয় থাকতে হবে। বিষয়টি কেবল এনএসএ নয়, বরং অন্যান্য সরকারি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরেও প্রযোজ্য।
সার্বিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যিনি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করেন। যদিও এনএসএ একটি রাজনৈতিক পদ এবং নিয়োগে আস্থা ও সম্পর্ক একটি বড় ভূমিকা রাখে। তবু সম্ভাব্য প্রার্থীর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানে তিনি কী ধরনের কার্যক্রমে যুক্ত—এসব বিষয়ও বিবেচনায় আনা উচিত।
এ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির অবশ্যই থাকতে হবে সমসাময়িক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সংকট সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, যাতে তিনি জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিটি বিষয়ে কার্যকর সেবা প্রদান করতে পারেন। সর্বশেষ হলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এনএসএ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির উচ্চ মেধা ও বিশ্লেষণক্ষমতা থাকতে হবে, যাতে তিনি প্রতিটি সমস্যা গভীরভাবে বুঝতে পারেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং এমন সমাধান খুঁজে বের করতে পারেন যা বাংলাদেশ ও এ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
ড. সাজ্জাদ মোহাম্মদ জসীমউদ্দীন: অধ্যাপক, কেজ বিজনেস স্কুল ও ফ্রান্সভিত্তিক জিওপলিটিকস স্ট্র্যাটেজি ল্যাবের প্রধান