jagonews24.com | rss Feed
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ এবং তাদের গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। এ ঘটনা ঘিরে সহিংসতায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। কয়েক দফায় সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলিতে রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এরপর বুধবার (১৬ জুলাই) রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করেছে সরকার। খবর বিবিসি বাংলার।
জেলায় প্রচুর সংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি শেষে ফেরার সময় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের হামলার মুখে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন এনসিপির শীর্ষ নেতারা। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কড়া পাহারায় গোপালগঞ্জ ত্যাগ করেন তারা।
এনসিপির দাবি, দলের নেতাদের হত্যার উদ্দেশে জঙ্গি কায়দায় এই হামলা চালানো হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীরাই এই হামলা চালিয়েছে। এ দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা ওই সংঘর্ষে নিহত অন্তত চারজনের মরদেহ হাসপাতালে এসেছে বলে বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেশ বিশ্বাস।নিহতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি হাসপাতাল কতৃপক্ষ।
এই সংঘর্ষের ঘটনায় আরও অনেকে আহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে।
এনসিপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে ঘিরে বুধবার সকালে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং পুলিশের গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেনি বলে দাবি করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
এদিকে, হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে, হামলাকারীদের বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে এনসিপি। এই কর্মসূচিকে ঘিরে মঙ্গলবার রাত থেকেই গোপালগঞ্জে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে গোপালগঞ্জের পৌরপার্ক এলাকায় এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলার ঘটনা ঘটে। অবশ্য তখনও দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশস্থলে পৌঁছাননি।
ওই সময় হামলাকারীরা সভামঞ্চের সাউন্ড বক্স, মাইক, চেয়ার ভাঙচুরসহ উপস্থিত এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় বলে বিবিসি বাংলাকে জানান ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক সাংবাদিক।
পরে এনসিপির নেতাকর্মীরা তাদের পাল্টা ধাওয়া দিয়ে সভাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন।
আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের হামলার জন্য দায়ী করে অচিরেই এর জবাব দেওয়া হবে বলে সমাবেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, মুজিববাদীরা আজ বাধা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে এবং সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। আজ আমাদের বাধা দেওয়া হয়েছে, অচিরেই আমরা এর জবাব দেবো ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, গোপালগঞ্জ নামের কারণে ভবিষ্যতে চাকরিক্ষেত্রে বা অন্য কোনো স্থানে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না- এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। গোপালগঞ্জে সন্ত্রাসীদের আস্তানা হতে আমরা দেবো না।
এরপর সমাবেশ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে হামলার মুখে পড়ে এনসিপি নেতাদের বহনকারী গাড়িবহর। দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বহনকারী গাড়িবহরের ওপর ব্যাপক ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে হামলাকারীরা। সে সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ।
পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় এনসিপির নেতাদের শহর থেকে বাইরে বের করার চেষ্টা করা হলেও ব্যাপক হামলার মুখে তাদের আবারও শহরে ফিরিয়ে আনা হয়।
কিছুক্ষণ পরে সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোঁড়েন বলে জানান ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা। এক পর্যায়ে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর ঘুরিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেনা পাহারায় এনসিপি নেতাদের গোপালগঞ্জ ত্যাগ
গাড়িবহরে হামলার পর প্রাথমিকভাবে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ দলের শীর্ষ নেতারা।
সেখানে এনসিপি নেতা নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা যখন রওনা দিয়েছি, তখন গ্রাম থেকে যত আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, সারা বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন এসে আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা এখন একটি জায়গায় অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হামলা প্রতিহত করতে কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন দলের নেতারা। এছাড়া মসজিদের মাইকগুলোতে ঘোষণা দিয়ে সন্ত্রাসীদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয় বলে জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অনেকে আহত হন। নিহত হন অন্তত চারজন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধরা জারি করে। পরে বিকেল ৫টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কড়া পাহারায় এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জ ছাড়েন।
হামলা হয়েছে পুলিশ এবং ইউএনও’র গাড়িতে
এনসিপির কর্মসূচিকে ঘিরে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং পুলিশের গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যে বুধবার সকাল ১০টার দিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উপজেলার উলপুর গ্রামে পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেয় বলে বিবিসি বাংলাকে জানান গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. সাজেদুর রহমান। বিষয়টি জানার পর একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে করে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রকিবুল হাসান।
পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে ইউএনওর গাড়িবহর গোপালগঞ্জ সদরের বৌলতলী ইউনিয়নের কংসুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে তাদের ওপর হামলা হয়।
ইউএনও এম রকিবুল হাসান বলেন, আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্য ওখানে গিয়েছিলাম। এর আগে পুলিশের গাড়ি পুড়িয়েছে। মূলত, ওইটা দেখতে গিয়েছিলাম আমরা এবং ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছিল।
কারা হামলা চালিয়েছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন।
হামলায় কর্মকর্তারা অক্ষত থাকলেও তাদের গাড়িচালক সামান্য আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
থমথমে পরিস্থিতি
গোপালগঞ্জে রাত ৮টা থেকে শুরু হয়েছে কারফিউ। চলবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত।
স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ধ্যার পরই অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে গোপালগঞ্জ শহর। ঘরে ফেরা কয়েকজন মানুষকে বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তায় দেখা গেলেও তাদের চোখেমুখেও ছিল আতঙ্ক। শহরজুড়ে টহল দিচ্ছে র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি উপস্থিতির কথাও জানিয়েছেন তারা।
পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে বাড়তি নজরদারিও করা হচ্ছে।
বিক্ষোভের ডাক এনসিপির
হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভ পালনের ঘোষণা দিয়েছে এনসিপি। এটি আওয়ামী লীগের অনেকদিনের পরিকল্পনা বলেও তারা দাবি করেছে।
রাত পৌনে ১০টার দিকে খুলনায় সংবাদ সম্মেলন করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বিক্ষোভ পালনের ঘোষণা দেন। তিনি এই হামলার ঘটনায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার তদন্ত দাবি করেছেন। একইসঙ্গে গোপালগঞ্জে নিহতের ঘটনারও তদন্ত চেয়েছেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, যতই হামলা, হত্যাচেষ্টা হোক- জুলাই পদযাত্রা থামবে না।
হামলার ঘটনায় বিএনপির উদ্বেগ
গোপালগঞ্জে এনসিপির ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। বুধবার বিকেলে এক বিবৃতিতে উদ্বেগের কথা জানান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতেই আওয়ামী লীগ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
দেশে আবারও যাতে ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে না পারে, সেজন্য দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব।
‘বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে না’
এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বুধবার বিকেলে সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এনসিপি আয়োজিত সমাবেশে বাধা দিয়ে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এনসিপি, পুলিশ এবং গণমাধ্যমের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ অ্যাকটিভিস্টদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ড বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে না। দায়ীদের দ্রুত চিহ্নিত করা হবে এবং বিচার নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের ওপর এরকম সহিংসতা করার জায়গা নেই।
এদিকে, পুলিশ ধৈর্য ধরে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, উচ্ছৃঙ্খলতা যা হয়েছে, সেটা যতটুকু সম্ভব আমরা ধৈর্যের সাথে প্রশমন করার চেষ্টা করছি। আমরা এখন রিইনফোর্সড (আরও পুলিশ সদস্য পাঠানো) করছি পুরো জিনিসটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। আমরা লেথাল (প্রাণঘাতী) কোনো কিছু ব্যবহার করছি না। তাই আমাদের একটু সময় লাগছে।
সূত্র: জাগো নিউজ
এএমএ