সুইডিশ বিট কবি বেন্‌তের নায়িকারা

Bangla Tribune

আগার অন তুর্কে-এ শিরাজি
বেদাস্ত অরাদ দেলে-এ মারা
বেখালে-এ হিন্দুবাস বখশম
সামরকন্দ ওয়া বুখারারা
—হাফিজ শিরাজি

(হে তুর্কি সুন্দরী তুমি যদি আমার
হারানো হৃদয় ফেরত দাও
শুধু সেই প্রিয়ার গালের তিলের জন্য
লিখে দেব সমরখন্দ—বুখারা।)

“ঘুম ভেঙে ইস্তাম্বুলের জেলে আবিষ্কার করি নিজেকে। সময়টা ১৯৬৮ সালের ক্রিসমাসের ছুটির মধুরতম দিনে। আমি ও এলিস দুই বন্ধু স্টকহোম হয়ে সাতদিন আগে পৌঁছেছি এই শহরে। উদ্দেশ্য স্পিরিচুয়াল দেশ ইন্ডিয়ায় গিয়ে বিট কবিদের মতো পৃথিবীতে কাউন্টার কালচার বা বিপরীত সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার তালিম নেওয়া। অতিরিক্ত মদ্যপান, স্বাধীন যৌনতা আর পুঁজির বিরুদ্ধে বিট জেনারেশনের প্রতিবাদ ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল আমাকে। আর যুদ্ধ-যুদ্ধ পৃথিবীর বিরুদ্ধে অ্যালেন গিন্সবার্গের (১৯২৬-১৯৯৭) ‘হাউল এন্ড আদার পোয়েমস’ (Howl and Other Poems, 1956) যা উৎসর্গ করেছিলেন কার্ল সলোমনকে, আর জ্যাক কেরোয়াকের (১৯২২-১৯৬৯) স্বতঃস্ফূর্ত গদ্যে লেখা উপন্যাস ‘অন দ্য রোড’ আমাদের ভ্রমণ যাত্রার সঙ্গী ছিল। আমাদের স্বপ্ন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মতো মশলা আর তন্তু মানে কার্পাসের দেশ ইন্ডিয়ায় যাত্রা ঠিকই, তবে একদম বিপরীত উদ্দেশ্যে। আমরা স্পিরিচুয়ালিটি আর ইন্ডিয়ার হাজার রকমের সংস্কৃতির পুণ্যভূমি আর জাদুবিদ্যার খোঁজে পথে নেমেছি। কিন্তু তুর্কি সুন্দরীর কাছে হাফিজের কবিতার মতো প্রশ্ন করার পূর্বেই কেন যে জেলে যেতে হলো সেই রহস্য আজও খুঁজে ফিরি। তুর্কি তরুণীর কাছে কী চেয়েছিলাম কৈশোরে হারিয়ে ফেলা কপোলে লাল তিল-ওয়ালা ইন্ডিয়ান সেই কিশোরীর খোঁজ? যদিও আমেরিকার পঞ্চাশের দশকের সাইলেন্ট জেনারেশন কিংবা বিট জেনারেশনও আমাদের আমেরিকা যেতে টানেনি। ঐ তারুণ্যের শুরুতে কেন ইন্ডিয়ার প্রতি আকর্ষণ? ইন্ডিয়ার প্রতি পর্তুগিজ ভাস্কো দা গামার (১৪৬০-১৫২৪) যে আকর্ষণ কিংবা আপনাদের মনে পড়বে ফার্দিনান্দ ম্যাগেলানের (১৪৮০-১৫২১) যে আকর্ষণ বিশেষ করে ইতালির ফ্লোরেন্স নিবাসী পণ্ডিত প্রথম সমুদ্র ভ্রামণিক লেখক আন্তনিও পিগাফেত্তা (১৪৯১-১৫৩১) তার উদ্ভট লেখার আকর্ষণ, আমাদের ইন্ডিয়া যাত্রার জন্য টানেনি। সমুদ্র ভ্রমণ নিয়ে পৃথিবীতে প্রথম লেখা পিগাফেত্তার ছোট ও মনকাড়া বইটি উদ্ভট ফুলঝুড়ি দিয়ে ভরপুর। পড়েছিলাম যদিও ইস্তাম্বুলের জেল থেকে বের হয়ে। তিনি নাকি এমন পা বিহীন পাখি দেখেছিলেন, যাদের নারী পক্ষিণীরা যারা পুরুষ পাখির পিঠে ডিম পাড়ে। এইসব উদ্ভট লেখনিই ম্যাজিক রিয়ালিজমের জন্ম দিয়েছিল লাতিন আমেরিকায়। ‘বিট’ জেনারেশনের সমকালীন লাতিন আমেরিকার ‘বুম’ লেখকদের লেখায় উঠে এসেছে এইসব। আমরা দুই বন্ধু সত্যিকার অর্থেই ইন্ডিয়ার হাজার হাজার বছরের স্পিরিচুয়াল ধারণা আর অহিংসার পাঠ নিতে যাত্রা করেছিলাম। আপনাদের মনে পড়বে ১৯৬০ সালের বোম্বের ছবি ‘মুঘল ই আজমের’ কথা। যেখানে নায়িকা ছিলেন মধুবালা। যার মূল নাম ছিল মমতাজ। আনিতা একবার্ক ষাটের দশকের সুইডিশ নায়িকার চেয়েও আমার ভালো লেগেছিল। যদিও আমি La Dolce Vita (১৯৬০) সিনেমাটি কয়েকবার দেখেছিলাম। আর মারগ্রেট যিনি সুইডিশ আমেরিকান বংশোদ্ভূত তাকে নিয়ে বন্ধুরা কৌতুক করতাম স্বপ্নের পরীদের রানি বলে। তার সিনেমা Viva Las Vegas এবং Bye Bye Birdle তখন কবি হওয়ার অভিপ্রায় ছিল না কিংবা ছন্দবদ্ধ কিছু কথা লিখে রাখতাম শুধু নোটবুকে।”


অনেকক্ষণ ধরে শুনছিলাম সুইডিশ বিট কবি বেন্‌ত উ বিয়র্‌ক্‌লুন্ডের (Bengt O Bjorklund, 1949-) রুদ্ধশ্বাসে বলা কথাগুলো। বেন্‌তের কৈশোর-উত্তীর্ণ তারুণ্যে আর স্বপ্নের দেশ ইন্ডিয়ায় পৌঁছানো সে যাত্রায় আর হলো না। সম্প্রতি বেন্‌ত এক কবিতায় লিখেছেন:

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যে খেলা
জীবন একটি পরিপূর্ণ চেনা-অচেনা খেলার মাঠ
খেলার জয়-পরাজয়
নিশ্চিত জেনেও খেলায় অংশগ্রহণ অনিবার্য
বন্ধুত্ব ও বন্ধুত্বহীনতার দ্বন্দ্ব
ব্যথা বা বিরহ, কঠিন আঘাতের
স্মৃতি যা কখনও ভোলা সম্ভব নয়
অফুরন্ত সুখের স্মৃতি যেমন
যা কেবলই একই মনে হয়
তেমনি দীর্ঘশ্বাসের শূন্যতা
একদিন তুমি শিশু হিসেবে এসেছিলে
এই পৃথিবীতে, ধরো যুবা বয়সে ফুটবল
খেলোয়াড়ের মতো কখনও নিদারুণ
গোল করেছিলে, কখনও নির্মমভাবে হেরে গেলে,
কখনও অনাহুতের মতো সাইড লাইনে
বসে থাকতে হলো দিনের পর দিন
কখনো জ্ঞাতে অজ্ঞাতে ফাউল করে হলুদ কার্ড খেয়েছ।
অফ সাইডের ধকল, বিরুদ্ধ দলের ঘৃণা
প্রবল উত্তেজনায় অফ সাইড
ফাউল, লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বিদায়।
এই মাঠ তোমার না, হঠাৎ দেখলে
বয়স নেই খেলার, বুড়ো হয়ে গেছ
তুমি…
তারপর জুতোগুলো তাকের উপর
ঘুম পাড়িয়ে রাখা।

আমাকে কবি বেন্‌ত বললেন, “শামীম শোনো, তুমি তো তোমার ইউরোপ ভ্রমণ, ইউরোপের সংস্কৃতি, তোমার চোখে এখানকার মানুষ বিশেষ করে গত দুইবারের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবে; বেশ লেখো। তার আগে ২০১৭ সালের একটি কবিতা শোনাই। এই সকল বিচিত্র অনুভূতি তোমার ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করবে; তুমিতো অনুভূতিপ্রবণ প্রাচ্যের কবি, তুমি সেই ইন্ডিয়ার পুণ্যভূমি থেকে আসা মিস্টিক সন্তান। তোমাকে কবিতা শোনাতে পেরে আর তোমার কবিতা শুনতে পেরে আমি ভীষণ আনন্দিত। আমি মানুষের মধ্যে মিশে যেতে পছন্দ করি। আমি শ্রমজীবী মানুষের ঘামের ঘ্রাণ পাই। আমি আমার সেই হারানো প্রেমিকার খোঁজে পথে পথে এখনও ঘুরি। যাকে ইস্তাম্বুল নয় শুধু মায়ের শহর মুলট্রা, স্টকহোমে, প্যারিসে, ভেনিসে, লন্ডনে, ডাবলিনে খুঁজেছি।

তুরস্কের ইস্তাম্বুল জেলের এক একটি দিন যেন সহস্রাব্দের যন্ত্রণা আর অভিজ্ঞতার গল্প। সে গল্প অন্য সময়ে বলব:

চাঁদের স্থির মুখ
যেন অন্ধকার জলের উপর
ভাসা স্বপ্ন, যেখানে মাছেরা
আরাধনা করে, আরও সময়ের জন্য
প্রার্থনা করে রুলেট টেবিলে

এখানে এক পার্থক্য আছে
একটি অভিযানে থাকা ব্যাঙ
এক বৃক্ষের মধ্যে হারিয়ে
যাওয়া বাতাস পুনরুদ্ধারে
নেমেছি আমরা, দেখো
নলখাগড়ার নীরবতা

দরকারি কচি ও সবুজ খড়গুলো
অধিক বৃষ্টির আশায়
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো, যেন
সোনোরিটি হলে এক যুবতী মেয়ে
যে কিনা সকালকে ঘণ্টা ধ্বনিতে
পরিণত করেছে, যাতে করে
মৃত মানুষ কাঁদতে পারে

পালাতে থাকা টিম্পানির
মতো ক্ষতবিক্ষত অথবা
উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি ও…

তাড়াহুড়ো করে আইন
প্রণয়নের মাধ্যমে
বিপথগামী এবং সাধারণ
দিনগুলিকে শাসন করার
বিধান দিয়েছো কেন হে
পর্টের বৃদ্ধ লোক।”

কবিতা শেষ করে বেন্‌ত থামলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “কবিতা যদি বুঝতেই পারতাম বিংবা বোঝাতে তাহলে কেউ কি লিখতো বলো?”

আমি প্রশ্ন করলাম, “তোমার এই চিত্ররূপময় কবিতার প্রতি আমার যতখানি মনোযোগ, তার চেয়ে কম নয় তোমার সেই জেলজীবন এবং তুর্কি তরুণীর গল্প শোনার প্রতি আগ্রহ।”

বেন্‌ত বললেন, “ওটাতো ক্লাইমেক্স পর্বে। তোমাকে এবার নিকৃষ্টতম ঔপনিবেশিক শোষকের পৃথিবীর একটি কবিতা শোনাব। আজও কীভাবে দাস ও দাসত্বের পৃথিবী থাকে? কেন আমরা কবিতা লিখছি? কেন মানুষে মানুষে বিভাজন রেখা? এই যুদ্ধবাজ শাসকরা কীভাবে মানুষকে দাসানুদাস বানাচ্ছে। ব্যবহার করছে ক্ষমতার। এই কবিতায় অতটা ভণিতা নেই, নেই চিত্রকল্পের আহাজারি।”

আমি বললাম, “বেন্‌ত তোমার মনে পড়বে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধত্তোর পৃথিবীতে কবি চেশোয়াভ মিউশ যখন বলছেন, ‘কাকে বলে কবিতা, যা তা না-বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষ?’”

আরো স্মরণ করিয়ে দিলাম তাদেউশ রুজেভিচ, পাবলো নেরুদা ও আমাদের নজরুল, সুভাষের কথা।

এখানে সহজ বাক্যবন্ধে বেন্‌ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন:

“মনে রেখো দাসদের,
পুরুষ-নারী ও শিশু
যাদের পেটানো দেহ
তপ্ত রোদের নিচে কাজ
করা এই কুটিল পৃথিবী
বিস্ময়কর সব প্রাসাদ
যাদের ঘামে, শ্রমে ও রক্তে
তৈরি—তারা কারখানা
কিংবা ইমারত গড়ায়
মালিকদের ঘৃণিত সব
আবদার মেটায়; প্রতিদিন
ধর্ষিত হয় নারী, শিশু
অপুষ্টিতে ভোগে মরে,
কেউ রাখি না যাদের খোঁজ
কোনো স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াই
চলে নির্যাতন, কোনো অনুমতি
ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য
দারিদ্র্য জন্মই যার আজন্ম পাপ
কম দামে কেনা বেচা হাজার
হাজার বছরের নিষ্ঠুর আন্ধার
ঢেউয়ের মতো প্রবাহিত এখনো
একটা চাবুক যেনো ঘোরে
ক্ষতবিক্ষত পিঠের উপর
নিপীড়িত জনতার।”

আমি বললাম, “ইউরোপতো অস্ত্র বানায়। আমার দেশে ২০০ মিলিয়ন মানে বিশ কোটি লোকের অর্ধেকের বেশি দারিদ্র্যসীমায়। তারা দাসের মতো মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম দেয়। উন্নত বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধের প্রস্তুতিতে বিভোর। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের গিনিপিগের মতো ভাবে। আমি তোমার শান্তির দেশ সুইডেনের যুদ্ধ জাহাজ বানানোর রেওয়াজ সম্পর্কে কথা বলব। তার পূর্বে তুমি তোমার শৈশবের বেড়ে ওঠা সম্পর্কে বিস্তারিত বলবে কি?”

বেন্‌ত এবার শৈশবে ফিরে গেলেন মা-বাবার স্মৃতিতে। স্কুল ভালো না লাগার গল্পে। বেন্‌ত বললেন, “আমার মা নট আউট ৯৭ এখন। নানা-নানির সপ্তম সন্তান। এই যে তোমার খোঁজ নিলো ফোনে। শুনতে পেলেতো।”

আমি উত্তরে বললাম, “হ্যাঁ।” কারণ বেন্‌ত গাড়ি চালাচ্ছিলেন আর লাউডে স্পিকারে ফোন ধরেছিলেন। আমি বললাম, “আমার বাবা, দাদা-দাদির এগারো মেয়ের পরে প্রথম ছেলে সন্তান।”

হো হো করে হেসে উঠলো বেন্‌ত, “একটা সময় ছিল ইউরোপে এক মায়ের পেটে দশের অধিক সন্তান জন্মাতো।”

আমি বললাম, “রবীন্দ্রানাথ ঠাকুর তার মায়ের চৌদ্দতম সন্তান।” তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, “এক বাপের এক মায়ের গর্ভে ১৪ সন্তান?” আমি বললাম, “ইয়েস মাই পোয়েট।”

বেন্‌ত বলল, “সুইডেনের ছোট্ট শহর মুলট্রা, যেখানে ১৬ বছর পর্যন্ত আমার মা থেকেছেন, এরপর ভাসটিরাস সিটিতে তার বড় বোনের সঙ্গে পাকাপাকি স্টকহোমে চলে আসেন বাবার সঙ্গে বিয়ের পর ১৯৪৬। ১৯৪৯ মধ্যে আগস্টে স্টকহোমের সাববাটসবুর্গ হসপিটালে আমার জন্ম। এর বছর দুই পরে আমার ছোট বোনের জন্ম। ছোট বোনের বয়স যখন চার তখন আমার বাবা পাশের বাড়ির এমন এক মহিলার প্রেমে পড়ে আমাদের ছেড়ে চলে যায়, যে মহিলা ছিলেন তার পরিবার পরিজন দ্বারা পরিত্যাজ্য। এরপর আমাদের সঙ্গে বাবার আর দেখা হয়নি।”

আমি ইউরোপের সংসারের সংস্কৃতি জানতে চাইলাম। বেন্‌ত বললেন, “তোমাকে বিস্তারিত বলব স্ক্যান্ডেনেভিয়ার নারী-পুরুষের সম্পর্ক, শহরতলি আর রাজধানীর মানুষের মধ্যের ব্যবধান। রাজনীতি, ব্যবসায়ী আর সাধারণ মানুষের মধ্যকার যাপিত জীবনের পার্থক্য।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার স্বপ্নের নায়িকার খোঁজ পেয়েছিলে?” প্রশ্ন করলাম, “প্রথম কোন দেশি নারীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তোমার?”

(চলবে)

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *