Google Alert – সেনা
ছুটছে ইলেকশনের ট্রেন। বাজছে ভোটের হুইসল। আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই তা স্টেশনে পৌঁছবে। এ চলতি পথে চেইন টেনে ট্রেন থামাতে পারবে না বলে আশাবাদী নির্বাচনমুখী দলগুলো।
ভোটের পর নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেবে অন্তর্বর্তী সরকার—এই অপেক্ষায় নির্বাচনমুখী দল ও ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহী মানুষ। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের বর্ষপূর্তিতে কথা ক্লিয়ার করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর কথার মাঝে কোনো ‘তবে-কিন্তু-যদি’র ব্যবহার ছিল না। ছিল একটু সতর্কতা। একটি মহল গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও নির্বাচনে এখনো বাধা বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
কোনো কোনো দল নির্বাচনের যাত্রাপথে যেসব শর্ত জুড়ে দিচ্ছে তা শেষতক হালে পানি পাবে না। বড়জোর কিছু ডিস্টার্ব হতে পারে। তবে নির্বাচনকে ঐতিহাসিক, প্রশ্নমুক্ত, অবাধ, সুষ্ঠু করার অভিপ্রায় কতটা সম্ভব হবে—এ ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
দেশ স্বাধীনের পর ’৭৩ থেকে ’৮৮ পর্যন্ত নির্বাচনগুলোর নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, দখলবাজির পর ’৯১-এ তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সুষ্ঠু নির্বাচনের সদিচ্ছা নিয়েও এমন ভাবনা ও সংশয় ছিল। উৎকণ্ঠা ছিল তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফেরও। তবে বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সুষ্ঠু-অংশমূলক নির্বাচনের নজির তৈরি হয় ৯১-এ। ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভূমিকা উহ্যই ছিল।
কিছুদিন আগে, ওই সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন খান কিঞ্চিৎ মুখ খুলেছেন ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভূমিকা নিয়ে।
বলেছেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একদিন তাঁকে বলেছিলেন, তাঁকে একটি চমৎকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা সেনাশাসন দিয়ে নয়, সেনাবাহিনীর অধীনে বা তত্ত্বাবধানে নয়, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেও নয়। নূরউদ্দিন খান যা বোঝার বুঝে নেন। পুলিশ থেকে শুরু করে আনসার পর্যন্ত সবার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে মিলিয়ে দিয়ে তিনি এমন একটা ম্যাজিক্যাল ব্যবস্থা করেন, যা ওই নির্বাচনটিকে ঐতিহাসিক মানদণ্ডে নিয়ে যায়। এরপর ৯৬, ২০০১ এমনকি ২০০৮ পর্যন্ত সেই ধারার কিছু ছোঁয়া ছিল। ২০১৪ থেকে বরবাদ হতে হতে ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে এসে নির্বাচন হয়ে ওঠে তামাশা-মসকরার বায়োস্কোপ। এর পরিণতিতে দেশে অনিবার্য নতুন প্রেক্ষাপট। দেশের নির্বাচন ছারখার করা ফ্যাসিস্টকুলের পতন, পলায়ন। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন আয়োজনের পালা। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জীবনের শেষ ইচ্ছা একটি ইতিহাস তৈরি করা। তাঁরা চাইলেই কি তা সম্ভব? তাদের চাওয়ার ওপরই কি সব নির্ভর করে?
প্রশ্ন বড় কঠিন। জবাব আরো কঠিন। এ নিয়ে উৎসুক মহলে নানা জিজ্ঞাসা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকর ঐক্য এখনো আসেনি। ফ্যাসিস্টের পতন হলেও বিদায় নেয়নি। গত অর্ধশতাব্দী নির্বাচনের বহু মডেল প্রদর্শন হয়েছে বাংলাদেশে। এখানে গণতন্ত্রের বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েকদলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনেরও এন্তার রকমফের! নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট, হ্যাঁ-না ভোট। সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপিরও নানা কলসাইন। মাগুরা, মীরপুর, ১৫ ফেব্রুয়ারি, বিনা ভোট, রাতের ভোট ইত্যাদি। এখন সামনে কোন মডেলের নির্বাচন, তা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচনেই আচানক মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ওই মডেল ভোটের জন্য আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। খাসপছন্দের খন্দকার মোশতাককে (পরবর্তী নাম খুনি মোশতাক) জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এরপর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, আওয়ামী লীগকে নৌকা-মই ইত্যাদি চার ভাগে সিট বণ্টনসহ নানা মডেল শো। এ শোতে আরো নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদের জমানায়। নির্বাচনের এই সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর ৯১-এ বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দীনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনী নাশকতা। হতে হতে ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ। এর আগে, ২০১৪ সালে বিনা ভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড।
২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে এবং ২০২৪ সালে এসে যোগ হয় ডামি-আমি মডেল। নুরুল হুদা গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিলেন, এবার আর দিনের ভোট রাতে হতে দেওয়া হবে না। তার আগেরজনের অঙ্গীকার ছিল ১৮ সালে ১৪ সালের মতো বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে পাস করতে দেবেন না তিনি। কথা রেখেছেন, বিনা ভোটে এমপি হওয়া কমিয়েছেন। কিন্তু দিনের ভোট রাতে এগিয়ে এনেছেন। আশা করা হয়েছিল ২০২৪ সালে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল দিনের ভোট রাতে কিংবা বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে এমপি বানাবেন না। তবে তিনি দেখিয়েছেন আমি-ডামির সার্কাস। ১৪, ১৮, ২৪ সালে নির্বাচনকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করার অংশীজনরা সিভিল-পুলিশ দুই প্রশাসনেই রয়ে গেছে। তারা এখনো অনেক ঝামেলা বাধানোর ক্ষমতা রাখে। তাই বলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা অন্যায্য? না, মোটেই না। মহাপরাক্রমশালী হওয়ার পরও ছাত্র-জনতা তাদের বিতাড়ন করেছে। এ কাজে দেশপ্রেমের সারথি হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ প্রশ্নে সেনাবাহিনী আর সেনা থাকেনি। তারাও জনতা হয়ে গেছে। এখনো মাঠে আছে জনতার কাছাকাছি। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে খবরদারি করছে না; বরং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সহায়তা করছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভূমিকা একটি বহুমাত্রিক এবং গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাহিনীর গৌরবময় আত্মত্যাগ ও নেতৃত্ব একদিকে যেমন জাতীয় পরিচয় নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে পরবর্তীকালে বারবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এই গৌরবময় ইতিহাসকে বিতর্কিত করে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনার পর এবং ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ড. ইউনূস সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ‘আমরা সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজে লাগাচ্ছি, যারা নিরপেক্ষ ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করবে।’
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে ও জনমনে বাড়তি ভরসা জুগিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নতুন সরকার দেখতে চাই। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কোনো ইচ্ছা নেই। স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব; কিন্তু রাজনীতির নেতৃত্ব রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত।’
সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে আরো বলেন, ‘যথাশিগগির সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো ২৮ জুলাই বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রায় ৬০ হাজারের মতো ট্রুপস নির্বাচনী ডিউটিতে থাকবে। তারা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।
বিশ্বজুড়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পরিবর্তিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে, যেখানে তাদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কঠোরভাবে সংরক্ষিত। অপরদিকে পাকিস্তান, তুরস্ক বা মিসরের মতো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ এখনো রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি মধ্যবর্তী পথে হাঁটছে। এখানে তারা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ভরসার নাম। এমন এক সময়ে তারা পাশে দাঁড়িয়েছে, যখন সামনে একটি নির্বাচন এবং যখন ভোটের সংস্কৃতি বরবাদের হোতাদের বিচার চলছে। তাই সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উচ্চাশা এবার ব্যাপক। শুধু নির্বাচন নয়, ভালো কিছুর জন্য মানুষের মধ্যে সেনাবাহিনীকে পাশে পাওয়ার তাড়নাও কাজ করে। সেনাবাহিনীর অধীনে নির্বাচনের কথা অনেকবার এসেছে। বিরোধী দলে থাকলে এ দাবি যত জোর দিয়ে উচ্চারণ করা যায়, সরকারে গেলে কথা ও সুরে বদল আসে। আবার বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন যত না ‘রেওয়াজ’, তার চেয়ে বেশি ‘প্রয়োজন’। এবারের প্রেক্ষিত ভিন্ন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করার ইতিহাস তৈরি হয়েছে চব্বিশের গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত বা মোক্ষম সময়ে।
দেশে এবারের সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে আছে সেনাবাহিনী। আর আছে বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআইভুক্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা বিবেকবানরা উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে।
মাদক কারবারি ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা-পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশি কাজও করে চলছে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বসভার সদস্যদের প্রতিক্রিয়ায়ও। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর এখন সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর অভিযাত্রার আকাঙ্ক্ষার কথা উঠে এসেছে। তাই পাশে, কাছে, তত্ত্বাবধানে, সহযোগে, সম্পূরকে যেভাবেই হোক সেনা সম্পৃক্ততায় একটি অবাধ-প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন