স্বাস্থ্য খাতে বাজেট না বাড়ায় সেবা ব্যাহত হচ্ছে

Google Alert – ইউনূস

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুস্পষ্ট নির্দেশনায় স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছিল। কমিশন দীর্ঘ ছয় মাস সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিজ্ঞ পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি বিস্তারিত সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে। আমরা মনে করি, এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিকের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবাকে প্রান্তিক জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। এ মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আমূল উন্নতির কোনো বিকল্প নেই এবং এ সংস্কার কার্যক্রম সেই উন্নতির পথে প্রথম ও সবচেয়ে জরুরি ধাপ।

একটি কার্যকর ও গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিনির্মাণের পথে আমাদের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো নীতিগত দুর্বলতা, জাতীয় বাজেটে অপ্রতুল বরাদ্দ, জনবলের তীব্র সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। সংগত কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট তাৎক্ষণিকভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় সংকটটি হলো জনবল। উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি একটি নিয়মিত অভিযোগে পরিণত হয়েছে, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিকে দারুণভাবে ব্যাহত করছে। অবকাঠামোগত দিক থেকেও আমরা বহুলাংশে পিছিয়ে আছি। উদাহরণস্বরূপ, একটি ৬০০ শয্যার হাসপাতালে যখন দুই হাজার রোগী ভর্তি থাকে এবং তাদের সঙ্গে আরো প্রায় তিন হাজার দর্শনার্থীর সমাগম হয়, তখন সেখানে মানসম্মত সেবা প্রদান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ, যা একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আমার উপলব্ধি হয়েছে যে, সরকারের একার পক্ষে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা ও অপ্রতুলতা নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দেশের মোট স্বাস্থ্যসেবার ৭০ শতাংশের বেশি প্রদান করে বেসরকারি খাত। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজগুলোর এ অনস্বীকার্য অবদানকে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। তাই বর্তমান বাস্তবতায়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) একটি অনিবার্য ও কার্যকর কৌশল। পাশাপাশি সেবাগ্রহীতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুরো প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করাও সমানভাবে জরুরি।

জনবল সংকট নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জরুরি ভিত্তিতে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার এমবিবিএস চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে, যা মোট অনুমোদিত জনবলের প্রায় ২৫ শতাংশ। এ সংকট মোকাবেলায় ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে তিন হাজার চিকিৎসক নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে চলেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, ইনশাআল্লাহ অক্টোবরের মধ্যেই ২ হাজার ৭০০ এমবিবিএস এবং ৩০০ বিডিএস চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে, যা বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসক সংকট নিরসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ প্রেরণ করেছে।

একইভাবে নার্স সংকটও আমাদের স্বাস্থ্য খাতের একটি বড় দুর্বলতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা থাকলেও আমাদের দেশের চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ঘাটতি পূরণে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর শিগগিরই ৩ হাজার ৫১২ জন নার্স নিয়োগ দেবে। জেলা পর্যায়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। ৬৪ জেলার মধ্যে ৩০টিতে এরই মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি জেলাগুলোয় প্রক্রিয়াটি চলমান।

বর্তমান ব্যবস্থাপনায় সরকার চাচ্ছে, আমরা সেবাদানকারী যারা তাদেরকে নিয়োগ দেব না। আমরা সেবা নিতে চাই অর্থের বিনিময়ে। আমরা সেবা ক্রয় করতে চাই। আমরা বলতে চাই—এ হাসপাতাল, এ ক্লিনিক, এ স্বাস্থ্য স্থাপনা ২৪ ঘণ্টা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। তারা কীভাবে সেটা নিশ্চিত করবে এটা তাদের বিষয়। আমরা এ বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে চাচ্ছি।

অভিযোগ রয়েছে, মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। আপনাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই, ইতিহাসে এই প্রথম সাত হাজার সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।

নাগরিকদের নিজ পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয়ের (আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার) প্রায় ৬৮ শতাংশই ওষুধের পেছনে খরচ হয়। এ বিপুল ব্যয়ভার সাধারণ মানুষের জন্য একটি বোঝা। এটি কমাতে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এরই মধ্যে ৩৩টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত করোনারি স্টেন্টের মূল্য ১০-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হ্রাস করা হয়েছে। সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডকে (ইডিসিএল) শক্তিশালী করার বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যেন দেশের প্রয়োজনীয় ওষুধের ৭৫ শতাংশ তারা সরবরাহ করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ১২১টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মধ্যে বর্তমানে ইডিসিএল মাত্র ৩১টি উৎপাদন করলেও তারা আশ্বস্ত করেছে যে আগামী চার মাসের মধ্যে আরো ২১টি এবং পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে বাকি ৬৯টি ওষুধ উৎপাদনে সমর্থ হবে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আশার একটি বিষয়। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে টিকা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে মুন্সিগঞ্জে একটি নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হচ্ছে।

আমাদের সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে আরো রয়েছে চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাত হাজার সুপারনিউমারারি বা সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির দীর্ঘদিনের জট নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া সহজ করার পাশাপাশি সেবার মূল্য নিয়ন্ত্রণেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনার জন্য আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

আমরা সংস্কারের বীজ বপন করে যাচ্ছি। এ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে হয়তো সবকিছুর পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই। এ সংস্কার বৃক্ষের যত্ন এবং এর ফল ভোগ করার দায়িত্ব থাকবে পরবর্তী নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের ওপর। আমরা অত্যন্ত আশাবাদী, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে একটি ইতিবাচক ও টেকসই পরিবর্তন আনা সম্ভব। ইনশাআল্লাহ, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

অধ্যাপক ডা. আবু জাফর: মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

[বণিক বার্তা আয়োজিত প্রথম ‘বাংলাদেশ হেলথ কনক্লেভ ২০২৫’-এ প্যানেল আলোচক হিসেবে

রাখা বক্তৃতায়]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *