১০ম পর্ব – হিল ভয়েস

হিল ভয়েস

হিল ভয়েস, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক:

‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১৭নং ধারায় উল্লেখ আছে যে, সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হবে এবং এই লক্ষ্যে সময়-সীমা নির্ধারণ করা হবে। আইন-শৃংখলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা হবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করতে পারবে।

পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৭-১৯৯৯ সালে পাঁচ শতাধিক ক্যাম্পের মধ্যে দুই দফায় মাত্র ৬৬টি অস্থায়ী ক্যাম্প এবং ২০০৯-২০১৩ সালের মেয়াদকালে ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়েছে। তবে প্রত্যাহৃত অনেক অস্থায়ী ক্যাম্প পুনর্বহাল করা হয়েছে। তার মধ্যে কেবল কোভিড-১৯ মহামারী কালে কমপক্ষে ২০টি ক্যাম্প পুন:স্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে বান্দরবানে কেএনএফের বিরুদ্ধে অপারেশন চলাকালে আরো নতুন ১৭টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।

পার্বত্য চুক্তির এ বিধান অনুযায়ী অস্থায়ী ক্যাম্পসমূহ স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া বিষয়ে কোন সময়-সীমা আজ অবধি নির্ধারিত হয়নি। ৫৪৫টি অস্থায়ী ক্যাম্পে মধ্যে ১০১টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হলেও এখনো প্রায় চার শতাধিক সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অন্যান্য অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি।

উল্লেখ্য, পূর্বের ‘অপারেশন দাবানল’ এর পরিবর্তে ১ সেপ্টেম্বর ২০০১ হতে সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি করা হয়। এই ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পর্যটন, উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে।

অন্যদিকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরিবর্তে ১৩ এপ্রিল ২০২২ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স থেকে “সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারকৃত ২৪০টি ক্যাম্পে পর্যায়ক্রমে পুলিশ মোতায়েন করা হবে” মর্মে এক নির্দেশনা জারি করা হয়।

পার্বত্য চুক্তির ১৭নং ধারার (খ) উপ-ধারায় আরো বলা হয়েছে যে, সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু চুক্তির এই ধারা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যাহৃত ক্যাম্পের জায়গা মূল মালিক বা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি। উপরন্তু ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাহ্যত সিভিল প্রশাসন বলবৎ থাকলেও অপারেশন উত্তরণের বদৌলতে কার্যত: সেনাবাহিনীই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাস্তাঘাটে চেকপোস্ট বসিয়ে সেনাবাহিনী পূর্বের মতো প্রয়োজন মনে করলে যাত্রীবাহী বাস-লঞ্চ থেকে শুরু করে সকল প্রকার যানবাহন তল্লাসীসহ গ্রামাঞ্চলে অপারেশন অব্যাহত রেখেছে। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের উপর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর বিগত ২৭ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *