৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে

Google Alert – সামরিক

৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে

সংগৃহীত ছবি

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক অডিওতে ইসরাইলি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধানকে বলতে শোনা গেছে, গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রয়োজনীয় ও অবশ্যম্ভাবী।’

তিনি বলেন, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত প্রতিটি ইসরাইলির বিপরীতে ৫০ জন তথা ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে। তারা শিশু না বৃদ্ধ তা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসব কথা বলেছেন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর (আইডিএফ) মেজর জেনারেল আহারন হালিভা। 

ইসরাইলের চ্যানেল ১২ প্রথম খবরটি সামনে আনে বলে সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন।

অডিওতে হালিভাকে আরও বলতে শোনা গেছে, গাজায় ইতিমধ্যেই যে ৫০ হাজার মানুষ মারা গেছে, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জরুরি। যদিও তিনি কবে এ মন্তব্য করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। তবে গাজায় নিহতের সংখ্যা চলতি বছরের মার্চে ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তার ভাষায়, আর কোনো বিকল্প নেই। কিছু সময় পর পর তাদের নাকবার মুখোমুখি করা হবে যেন তারা মূল্যটা বোঝে। আরবি শব্দ নাকবার অর্থ বিপর্যয়। এটি ফিলিস্তিনি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের সময় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র ইহুদি গোষ্ঠীর আক্রমণে পালিয়ে যায় বা উৎখাত হয় সেটিই নাকবা দিবস নামে পরিচিত।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যখন দক্ষিণ ইসরাইলে হামলা চালিয়ে ১২০০ জনকে হত্যা করে এবং আরও ২৫০ জনকে অপহরণ করে হালিভা তখনই ইসরাইলি সামরিক গোয়েন্দার প্রধান ছিলেন। ২০২৪ সালের এপ্রিলে তিনি ‘নেতৃত্বের দায়’ স্বীকার করে পদত্যাগ করেন এবং এভাবে এমন পদ থেকে প্রথম উচ্চপদস্থ আইডিএফ কর্মকর্তা হিসেবে সরে দাঁড়ান। দীর্ঘ রেকর্ডিংগুলো সম্ভবত হালিভার একাধিক আলাপচারিতা থেকে নেওয়া, যদিও চ্যানেল ১২ উল্লেখ করেনি তিনি কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। এসব রেকর্ডিংয়ে হালিভার মূল দাবি হলো, ৭ অক্টোবরের হামলার দায় শুধু সেনাবাহিনীর নয়।

তিনি ইসরাইলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেতকেও দায়ী করেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল হামাস কোনো হামলা চালাবে না। অডিওর ব্যাপারে চ্যানেল ১২-কে দেওয়া এক বিবৃতিতে হালিভা বলেন, এসব কথা একান্ত আলোচনায় বলা হয়েছিল এবং এখন আমি শুধু দুঃখই প্রকাশ করতে পারি। তিনি গতানুগতিক উপায়ে দাবি করেন, এগুলো খণ্ডিত অংশবিশেষ, যা সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না। বিশেষ করে জটিল ও বিস্তারিত বিষয়ে। যেগুলোর অধিকাংশই অতি গোপনীয়।

গাজায় যুদ্ধ ও গাজা সিটি দখলের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে ইসরাইলের সমালোচনা ক্রমেই বাড়ছে। গত সপ্তাহে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাক্সন বলেন, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘পথ হারিয়ে ফেলেছেন’ এবং গাজা সিটি দখল করা হবে ‘পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য’। শুক্রবার ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন জাইল্যান্ডস-পোস্টেন পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, এখন নেতানিয়াহুই নিজেই এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

হামাস এক বিবৃতিতে হালিভার মন্তব্যের নিন্দা জানিয়ে  বলেছে, এই অডিও প্রমাণ করে আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে চালানো আগ্রাসন ইসরাইলের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তেই হয়েছে এবং এটিই তাদের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা নেতৃত্বের সরকারি নীতি। গত নভেম্বরেই জাতিসংঘের এক বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ইসরাইলের কর্মকাণ্ড ‘গণহত্যার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’ 

গত মাসে দুই ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থাও ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আনে। বরাবরের মতো ইসরাইলি সেনাবাহিনী এ সিদ্ধান্তকে ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। ইসরাইল বারবার গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনেই কাজ করছে। আর তার এই গণহত্যা অস্বীকারে সঙ্গী হয়েছে পশ্চিমারা। 

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যখন শতাধিক ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে, পশ্চিমারা দ্রুত তাদের কর্মকাণ্ডকে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা করতে এগিয়ে আসেন। হামাসকে নব্য নাৎসি আখ্যা দেওয়া হয়। যারা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরাইলের ব্যাপক হামলার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে তারা হামাস-সমর্থক ও ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং ইসরাইলের পাল্টা হামলা সম্পূর্ণভাবে ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে ন্যায্যতা পেয়েছিল।

প্রায় দুই বছর পর, পশ্চিমা বিশ্ব যে অভিযানকে সমর্থন করেছিল তা শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণ্য গণহত্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। আত্মরক্ষার পরিবর্তে, ইসরাইল নির্মমভাবে গাজাকে ধ্বংস করেছে, হত্যা করেছে, আহত করেছে, গৃহহীন করেছে এবং মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখেছে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট ফিলিস্তিনিদের বের করে দিয়ে নতুন ইহুদি বসতি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথিত ‘রিভিয়েরা’ নির্মাণের হুমকি দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়, ইসরাইলের নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার দেশের জিম্মিদের বলি দিয়েছেন। অথচ এই জিম্মিদের কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব নেতানিয়াহুর আগ্রাসনকে সমর্থন করে গেছে। আর নেতানিয়াহু অবিরাম সহিংসতা চালিয়ে গেছেন তার দক্ষিণপন্থি সরকারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

তবু সত্য চাপা থাকেনি। গাজার সাধারণ মানুষ মোবাইল ফোনে বিশ্বকে দেখিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞের ছবি। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যতই পক্ষপাতদুষ্ট হোক না কেন, দৃশ্যগুলো দাগ কেটেছে জনমতের গভীরে। আজ ব্রিটেন আর আমেরিকার প্রায় অর্ধেক নাগরিক মনে করে, গাজায় গণহত্যা চলছে। যে অভিযোগ একসময় প্রান্তিক মত ছিল, সেটিই এখন প্রায় সর্বজন স্বীকৃতি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত সতর্ক করেছিল, ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার ঝুঁকি বাস্তব। তবু পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যম তা অগ্রাহ্য করে, এমনকি ‘গণহত্যা’ শব্দটাই নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বছর ঘুরতেই চিত্র বদলায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন, আর ক্ষুধায় কঙ্কালসার শিশুদের ছবি, শেষমেশ পশ্চিমাদের সব ভণ্ডামি উন্মোচন করে দেয়।

তবু সরকারগুলো অস্বীকারেই অটল। কারণ একবার স্বীকার করলে ‘প্রতিরোধ ও শাস্তি’ দিতে হবে। যা তারা এড়িয়ে যেতে চায়। অথচ নেতারা নিজেরাই জানেন, অপরাধ হচ্ছে। কিয়ার স্টারমার এক দশক আগে আন্তর্জাতিক আদালতে বসনিয়ার গণহত্যার মামলা লড়েছিলেন। আজ তিনি নিশ্চুপ। উল্টে ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস নেতানিয়াহুকে আকাশপথ দিয়েছে; পোল্যান্ড তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে আউশভিৎস স্মরণে। ইতিহাসের সঙ্গে এই প্রহসন কেবল ভণ্ডামির নগ্ন উদাহরণ। কিন্তু গাজার ক্ষুধার্ত শিশুর ছবি এমন সত্য যা আর অস্বীকার করা যায় না। ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত মানতে বাধ্য হয়েছেন। সে কারণেই হয়তো স্টারমার, ম্যাক্রোঁ, কার্নির মতো মধ্যপন্থি নেতারা এখন অন্তত মুখে ইসরাইলের নৃশংসতায় আপত্তি তুলছেন।

তাদের হাতিয়ার হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। যা বাস্তবে কিছুই বদলাবে না, তবে প্রমাণ করবে যে-পশ্চিমাদের ভেতর এক গভীর সংকট জন্ম নিয়েছে। এ সংকট সহজ নয়। ইসরাইল তার নীতি না বদলালে এই গণহত্যা হবে পশ্চিমাদের ঘাড়ের দায়। ইসরাইলের ভেতর থেকেও এখন সমালোচনার স্রোত উঠছে। এ পথ দেশটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেউ কেউ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আহ্বান তুলছেন। তাদের দাবি, কেবল বাণিজ্য স্থগিত নয়, ‘অভূতপূর্ব শাস্তি’ চাই।

তবু পশ্চিমারা থমকে আছে তিন কারণে। প্রথমত, তারা নিজেরাই দুই বছর ধরে ইসরাইলের পক্ষে এত কিছু বলেছে যে এখন সরে আসা তাদের জন্য লজ্জাজনক। দ্বিতীয়ত, ইসরাইল অর্থনীতি, অস্ত্র, সংস্কৃতির দিক থেকে পশ্চিমে গভীরভাবে প্রোথিত। তৃতীয়ত, ইসরাইলের বিরুদ্ধে মানে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও দাঁড়ানো-যা তারা সাহস করে না। কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। ট্রাম্পের উগ্র সমর্থনই ইউরোপীয়দের সামনে এখন প্রশ্ন তুলছে-তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের ছায়াতেই চলবে, নাকি নিজের মানবিক দাবির সঙ্গে সৎ থাকবে?

ইউনিভার্সিটি অব সাসেস্কের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও গবেষক মার্টিন শ বলেছেন, এখনই সময় সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের দাবি তোলার। অস্ত্র, বাণিজ্য, সংস্কৃতি সব বন্ধ করতে হবে। গণহত্যায় জড়িত ইসরাইলি নেতাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে হবে। কেবল প্রতীকী প্রতিবাদ নয় অভূতপূর্ব বর্জনই ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রকে নড়াতে পারে। তবে এ কাজ সহজ নয়। বিশেষ করে ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য। কিন্তু যদি ‘হলোকাস্টের পর আর কখনো নয়’ কথাটি মানতে হয়, তবে তা ইসরাইলের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসরাইলি মানবাধিকার কর্মী ও চিকিৎসকদের কণ্ঠ তাই এই লড়াইয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ সিলমোহর।

এমএইচ

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *