Google Alert – সেনাবাহিনী
অন্য দশটা সকালের মতো সেদিনের সকাল ছিল না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, উৎকণ্ঠা, ভয় আর দৃপ্ত শপথের এক অবিশ্বাস্য সকাল ছিল সেদিন। রাজধানীসহ সারাদেশে গুমোট পরিবেশ, রাস্তাঘাট নিস্তব্ধ, চারদিকে যেন একটা অজানা উৎকণ্ঠা। বিগত ৩৫ দিনের আন্দোলনে শহীদদের স্বজনদের চাপা কান্না আর রাজপথে না শুকানো রক্তের দাগ- এমন ভীতিকর পরিবেশ দেশের আনাচে কানাচে। এতকিছুর পরও এক বিস্ফোরণের প্রতীক্ষায় ছিল পুরো দেশ।
সকাল ১০টায়ও সেদিন ঢাকার রাস্তাগুলো ছিল অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ। মোড়ে মোড়ে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন। ফাঁকা সড়কে কোথাও কোনো শব্দ নেই। গুটিকয়েক মানুষ বের হয়েছে জরুরি কাজে। রাস্তায় অটোরিকশা আর দু-একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দেখা যায়। যারা বের হয়েছেন তাদের চোখে-মুখে ভয় আর অজানা আতঙ্ক।
গন্তব্য শাহবাগ
সকাল ১০টা ৩০ মিনিট। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি হাসপাতাল) বহির্বিভাগের সরু গলিতে জড়ো হয়েছেন শতাধিক মানুষ। তাদের কয়েকজনের হাতে হ্যান্ড মাইক, মুখে স্লোগান। শাহবাগ থেকে সায়েন্সল্যাব সড়কে সেনাবাহিনীর তিন-চারটি গাড়ি আর কিছু সেনাসদস্য টহল দিচ্ছিলেন।
জাগো নিউজকের পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে ওই গলি থেকে বের হওয়ার অনুমতি মেলে এই প্রতিবেদকের। শাহবাগ মোড়ে তখন সুনসান নীরবতা। কড়া তদারকিতে রেখেছেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। সাঁজোয়া যানসহ সৈনিকরা অবস্থান করছেন শাহবাগে।
বেলা ১১টার দিকে রিকশায় করে পিজি হাসপাতাল ও বারডেম থেকে কিছু রোগীকে বের হতে দেখা গেলো। তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক, দিশেহারা রিকশাচালকরাও। ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে রোগীর স্বজন সবাইকে তল্লাশি করছে সেনাবাহিনী। শাহবাগ এলাকায় কাউকে দাঁড়াতেও দিচ্ছেন না তারা। একই সঙ্গে শাহবাগ থানার সামনেও প্রায় ১০০ পুলিশ মোতায়েন। টিএসসি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত কিছু বিচ্ছিন্ন আন্দোলনকারী ও গণমাধ্যমকর্মীরা হাঁটাহাঁটি করছিলেন।
বেলা সাড়ে ১১টার পর শাহবাগ মোড় থেকে শোনা যাচ্ছিল গুলির শব্দ। চানখাঁরপুল থেকে আসছে গুলির শব্দ, মাঝেমধ্যে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও আসছিল। ঢাকার বাতাস তখন আরও ভারী হয়ে উঠলো, এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র!
দুপুর ১২টা নাগাদ শাহবাগ প্রায় জনশূন্য। কেবল সেনা সদস্য ও সংবাদকর্মীরা অবস্থান করছিলেন শাহবাগ মোড়ে। সোয়া ১২টার দিকে হঠাৎ করেই কোলাহল ভেসে আসছিল মৎস্য ভবনের দিক থেকে। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল এক দফা স্লোগান। এরপর ধীরে ধীরে শাহবাগে এগিয়ে আসে প্রায় ৫০০ মানুষের মিছিল। সেই মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন প্রায় ৫০ জন নারী।
মিছিলে ছিলেন ১৬ বছরের কিশোর থেকে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ, কারও চেহারায় কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই। এগিয়ে আসা মিছিলের স্পষ্ট স্লোগান জানিয়ে দিচ্ছিল এ জনতাকে আর রুখবার নেই কেউ। ওভারব্রিজের পাশে সেনাবাহিনী তাদের থামাতে চাইলে মিছিলের প্রথম সারিতে থাকা আন্দোলনকারীরা হাতে ফুল তুলে দিলেন সেনাসদস্যদের। মুহূর্তেই বদলে গেলো দৃশ্যপট।
শাহবাগ মোড় জুড়ে ভরে গেলো মানুষের স্রোত। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড পার হয়ে শাহবাগ মোড়ে বসে পড়লেন আন্দোলনকারীরা। চারিদিকে শুধু স্লোগান।
বেলা গড়াতেই মানুষের স্রোত আরও বাড়তে লাগলো, শাহবাগ রূপ নিলো গণজাগরণে। ঠিক তখনই খবর এলো- সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। এরপর বজ্রপাতের মতো ছড়িয়ে পড়ে খবর- শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুরু হয় জনতার উল্লাস।
এরপর জনতার ঢল নামে শাহবাগে। শুধু ঢাকা নয়, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশ থেকে মানুষ ছুটে আসে শাহবাগে। শাহবাগ হয়ে ওঠে এক বিজয়ের মঞ্চ। এখানে তখন এক অন্যরকম দৃশ্য। কেউ কাঁদে, কেউ হাসে। কেউবা আবার মাটিতে বসে সিজদা দেন। কেউ সেনাসদস্যদের জড়িয়ে ধরে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় শাহবাগসহ আশপাশের সড়ক। লক্ষাধিক মানুষের সমাগম তখন শাহবাগে। ততক্ষণে ইন্টারনেট স্বাভাবিক হয়েছে। বিজয় মিছিল নিয়ে সবাই যাচ্ছেন গণভবনে।
আরএএস/কেএসআর