Samakal | Rss Feed
৭ দিন পর হাসপাতাল বলল, ধর্ষণের আলামত মেলেনি
সারাদেশ
চট্টগ্রাম ব্যুরো ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি <time class="op-modified" dateTime="2025-10-01"2025-10-01
2025-10-01
খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার সাত দিন পর ডাক্তারি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। এতে আদিবাসী ছাত্রীকে ধর্ষণের আলামত মেলেনি। আলামত পরীক্ষার ১০টি সূচকের সব কটিতে স্বাভাবিক লেখা রয়েছে।
এ ঘটনায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জন অফিস থেকে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনটি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ধর্ষণের আলামত পরীক্ষায় তিন চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেওয়া খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসক জয়া চাকমা বলেন, ‘সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমরা করেছি। কিন্তু ধর্ষণের আলামত পাইনি।’
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ জয়া বলেন, ‘আমাদের দলে হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন ও নাহিদা আকতার ছিলেন।’
জেলা সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদ বলেন, ‘কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড গতকাল তাদের প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়েছে।’
মেডিকেল বোর্ডপ্রধানের উদ্ধৃতি দিয়ে সিভিল সার্জন বলেছেন, ওই ছাত্রীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আরেফিন জুয়েল বলেন, মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে– সেই ছাত্রী ধর্ষিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। অথচ মিথ্যা একটা অভিযোগ তুলে একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পার্বত্যাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এখন তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
আদিবাসী ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে বিক্ষোভ ও উত্তেজনা চলছে খাগড়াছড়িতে। গত রোববার গুইমারা উপজেলায় গুলিতে তিনজন মারা গেছেন। তাদের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার রাতে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতরা হলেন– গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যানপাড়ার আথুই মারমা (২১), হাফছড়ি ইউনিয়নের সাং চেং গুলিপাড়ার আথ্রাউ মারমা (২২) ও রামেসু বাজার বটতলার তৈইচিং মারমা (২০)।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে ওই কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি ক্ষেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
চলছে না গাড়ি, বন্ধ দোকানপাট
খাগড়াছড়ি শহর থেকে দীঘিনালা, বাঘাইছড়ি আর লংগদুগামী গণপরিবহনের স্টেশন ন্যান্সীবাজার। প্রতিদিন বাজারটি হাজারো মানুষে মুখরিত থাকলেও গতকাল মঙ্গলবার সকালে সেখানে ছিল ভিন্ন চিত্র। বাজার ও স্টেশন একেবারে ফাঁকা। এই এলাকায় একই পরিস্থিতি দেখা গেছে বিকেলেও। শুধু এই গণপরিবহন স্টেশনই নয়; সংঘাত-সংঘর্ষের জের ধরে অবরোধ ও ১৪৪ ধারা জারি থাকায় খাগড়াছড়ির মানুষ বিপাকে পড়েছেন।
গাড়ি চলাচল বন্ধ, দোকানপাট খোলা যাচ্ছে না। কাজ-কর্মে যেতে পারছেন না শ্রমজীবীরা। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন খেটে-খাওয়া মানুষ। এ নিয়ে তাদের ক্ষোভের শেষ নেই। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসুক– এমনটাই চান তারা। এদিকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত অবরোধ স্থগিত করা হয়েছে।
ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল খাগড়াছড়িতে গতকালও সড়ক অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি চতুর্থ দিনের মতো বলবৎ ছিল ১৪৪ ধারা। এতে পুরো খাগড়াছড়িতে স্থবিরতা নেমে আসে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হননি। কোনো কারণে বের হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
প্রশাসনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন
হতাহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গুইমারার রামেসু বাজার পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল। উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া হয়। জেলা পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ মামলা করতে এগিয়ে না আসায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল রয়েছে। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, অবরোধ প্রত্যাহার করা হলে পরিস্থিতি বুঝে ১৪৪ ধারাও তুলে নেওয়া হবে।
অবরোধ স্থগিত
জুম্ম ছাত্র-জনতার মিডিয়া সেল জানিয়েছে, প্রশাসনের আশ্বাস ও উদ্যোগের প্রতি আস্থা রেখে এবং সনাতন সম্প্রদায়ের দুর্গোৎসবকে সম্মান জানিয়ে মঙ্গলবার রাত ১১টা থেকে ৫ অক্টোবর বা পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অবরোধ স্থগিত করা হয়েছে।
স্থবিরতায় কর্ম হারিয়ে বিপাকে খেটে-খাওয়া মানুষ
খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কোয়ার। এখানে রয়েছে পানছড়ি বাস স্টেশন। খাগড়াছড়ির মূল বাস-ট্রাক স্টেশনও এটি। খাগড়াছড়ির প্রধান বাস ও ট্রাক স্টেশনে আটকা পড়ে আছে মালবাহী বহু ট্রাক। চালক-শ্রমিকরা অবরোধে আটকা পড়ে বিপদের সম্মুখীন। গতকাল দেখা গেছে, শতাধিক দরিদ্র শ্রমিক মিলে খিচুড়ি রান্না করে খাচ্ছেন। কয়েকজন শ্রমিক জানান, অবরোধ ও ১৪৪ ধারা জারির পর থেকে এভাবে দিন যাচ্ছে তাদের। তারা সবাই আবার ‘খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন চালক সমবায় সমিতি’র সদস্য।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব বাসেক জানিয়েছেন, বেশির ভাগ পরিবহন শ্রমিক দিনের আয়ে দিন চলেন। আয় বন্ধ থাকলে পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েন।
স্কুল শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনাস্থল সিঙ্গিনালা। এটি শহরের উত্তর প্রান্তে। এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পূজামণ্ডপে গিয়ে আনসার ছাড়া আর কাউকেই দেখা যায়নি। একজন পূজারি মিন্টু দে জানান, মহাষ্টমীর দিনেও ঢোল বাজেনি। বাজছে না মাইক কিংবা ঢোল। একই অবস্থা শহরের পূজামণ্ডপগুলোতেও।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তমাল দাশ লিটন জানান, সার্বিক বাস্তবতায় জেলাজুড়ে এবার সনাতনী জনগোষ্ঠীর প্রধানতম এ উৎসব ম্লান হয়ে গেছে।
খাগড়াছড়ি শহরে পঞ্চাশের বেশি আবাসিক হোটেল আছে। খাবার হোটেলের সংখ্যা এর দ্বিগুণ। মূলত পর্যটকের ওপরেই তাদের ব্যবসা নির্ভরশীল। আবার এই খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হালকা যানবাহনের ব্যবসাও। হোটেল মালিক অনন্ত ত্রিপুরা বলেন, সব কটি আবাসিক হোটেল বুকিং থাকলেও এখন বাতিল হয়ে গেছে। পর্যটকনির্ভর পরিবহন এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিক সবার মাথায় হাত পড়েছে।
খাগড়াছড়ি শহরের পাশাপাশি শহরতলির ছোটখাটো বাজারের পরিস্থিতি আরও খারাপ। গতকাল বিকেলে শহরতলির বটতলী, আপার পেরাছড়া, ধর্মঘর, ঠাকুরছড়া, কমলছড়ি এবং পেরাছড়া বাজারে গিয়ে এক রকম নীরবতা দেখা গেছে।।
অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ৯ দফা দাবি
গুইমারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন ৪১ বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে তারা বলেন, কোনো বাহিনী আইনের শাসন ও মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে নয়। মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনায় কেউ জড়িত থাকলে তাকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
সাজেক পর্যটকশূন্য
রাঙামাটি অফিস জানায়, খাগড়াছড়ির সহিংস ঘটনায় সাজেক পর্যটন কেন্দ্রে প্রভাব পড়লেও রাঙামাটি শহরে পর্যটকের ভিড় রয়েছে। বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ সর্তক রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। এরই মধ্যে পূজার ছুটি উপভোগ করতে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা ছুটে এসেছেন রাঙামাটিতে।
রাঙামাটি আবাসিক হোটেল মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মোস্তফা কামাল উদ্দীন জানান, দুর্গাপূজার ছুটি ঘিরে পর্যটকদের আগমনে খাগড়াছড়ির সহিংসতার প্রভাব রাঙামাটি শহরে বিন্দুমাত্র পড়েনি।
