jagonews24.com | rss Feed
দেশের অনেক মানুষ গোগ্রাসে খেয়েই চলেছে। তাদের আচরণ দেখলে মনে হয় শুধু গোগ্রাসে ভক্ষণের জন্যই মানুষের জন্ম। হুমায়ূন আহমেদের কোনো গল্প অথবা নাটকে দেখেছিলাম, একটি উজ্জ্বল রঙের পাহাড়ি মোরগকে ঘুরে বেড়াতে দেখে একজন প্রথমেই বলে উঠলেন, “ইস যদি কষিয়ে রান্না করে খেতে পারতাম।” লেখক মন্তব্য করেছিলেন- “এই হচ্ছি আমরা যারা সুন্দর কিছু দেখলেই খেয়ে ফেলতে চাই। সেটাকে উপভোগ করি না।” জাতি হিসেবে সেই খাওয়ার চর্চা আমরা চালিয়েই যাচ্ছি। যা কিছু সুন্দর, সেটাকে ভেঙে, কেটে, গুঁড়িয়ে দিয়ে অপার শান্তি লাভ করি।
খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে বাড়ি, গাড়ি, জমি, টাকা, পাথর, পাহাড়, সমুদ্র, নদী-নালা, জায়গা-জমি, বসতভিটা এবং মানুষ। এদের খাওয়া যেন কোনো কালে শেষ হওয়ার নয়। এই শ্রেণির মানুষের একটাই পরিচয়, এরা খেকো। বছরের পর বছর ধরে এরা খেয়েই চলেছে। দিনে দিনে এই খাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এই খাওয়ার কাজে জড়িত যে দুর্বৃত্তরা, তারা শক্তিশালী। টাকা দিয়ে এরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখে। যেকোনো সুন্দর ধ্বংস করার জন্য এই অসৎ ও অমানবিক মানুষগুলোর জন্ম। এরা প্রকৃতি ও প্রাণী নির্বিচারে ধ্বংস করে চলেছে।
প্রসঙ্গত মনে পড়লো একটি অ্যানিমেশন ফিল্মের কথা। জাপানের স্টুডিও জিবলির অ্যানিমেটেড ফিল্ম “স্পিরিটেড অ্যাওয়ে”তে দেখানো হয়েছে বাবা মায়ের সাথে নতুন শহরে আসে ছোট্ট মেয়ে চিহিরো। আসতে গিয়ে পথ হারিয়ে একটি ছোট্ট বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে তারা। সেই বনের ভেতরে দিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ সামনে দেখে একটি প্রাচীন বাড়ির গেট ও একটি আজব মূর্তি।
চিহিরো পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে ভয় পায়, ফিরে যেতে চায়। বাবা মা তাকে গাড়িতে থাকতে বলে। বলে তারা বাড়িটির ভেতরটা দেখেই চলে আসবে। একা একা ভয় পেয়ে চিহিরো তাদের পিছু নেয়। চিহিরোর বাবা-মা বাড়িটির ভেতরে গিয়ে দেখে বাড়িটির অন্যদিকে একটি বাইরে বের হওয়ার পথ। সেটি দিয়ে এগিয়ে তারা দেখে ভিন্ন একটি শহর কিন্তু সেখানে কোনো লোকজন নেই।
সেখানে তারা খাবারের সুগন্ধ পেতে থাকেন। একটু এগিয়েই তারা দেখেন টেবিলে সারি সারি খাবার রাখা কিন্তু কোন ওয়েটার বা সেলসম্যান নেই। একটু ডাকাডাকি করে মা-বাবা ভাবেন, সমস্যা নেই, কাউন্টারে লোক এলে বিল দিয়ে দেবেন তারা, ক্রেডিট কার্ড তো আছেই। সুস্বাদু খাবারগুলো খেতে শুরু করেন তারা।
ওদিকে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে চিহিরোর ভয় আর শঙ্কা কাটে না, তাই সে কিছু খায় না। বাবা মাকে ছেড়ে আজব ভীতিকর এলাকাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখতে থাকে চিহিরো। আগে কখনও খায়নি এমন সব সুস্বাদু খাবার গোগ্রাসে খেতে থাকেন চিহিরোর বাবা-মা। চিহিরো ঘুরে এসে পেছন থেকে দেখে মা বাবা বেশ মোটা হয়ে গেছেন খেতে খেতে। ভয় পেয়ে তাদের ডাকলে তারা ফিরে তাকায়। চিহিরো দেখে খেতে খেতে তার বাবা-মা শুকরে পরিণত হয়েছেন। চিহিরোর বাবা-মায়ের মতোই অবস্থা হয়েছে আমাদের দেশের একটি শ্রেণির।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা পাথর এলাকাটি অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। গত ৮/১০ বছর ধরে এখানে পর্যটকদের পদচারণা বেড়েছে বহুগুণ। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার স্রোতে অবগাহন করে মানুষের ক্লান্তি দূর হতো। পাশে পাহাড়, সবুজ বনানী, পাহাড়ি নদীর এই সৌন্দর্য অবর্ণনীয়।
সেখানে চোখ পড়েছে দুর্বৃত্তদের। গত একবছরে এলাকার রাজনৈতিক দল, এলাকাবাসী, পাথর ব্যবসায়ী, বিভিন্ন গ্যাং এবং এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ী একত্রিত হয়ে এলাকার সব সাদা পাথর তুলে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকায় এমন অবাধে লুটপাট চলছে, যে দেখে মনে হবে এগুলো দেখার কেউ নেই, নেই কারো দায়দায়িত্ব।
এদেশে চোরা শিকারিরা গোপনে বাঘ, হরিণ শিকার করে, হাতি হত্যা করে শিং কেটে নিয়ে যায়। রাতের আঁধারে বনখেকোরা বন লোপাট করে। কিন্তু এবার তারা লুটপাট করছে দিনেদুপুরে। অবাধে লুটপাটের কারণে বিলীন হবার উপক্রম ওই পর্যটন স্পটটি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দাবি করা হলেও বাস্তবে লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই দায়ী করছেন প্রশাসনকে। এর আগে অল্পস্বল্প চুরি হয়েছে রাতের আঁধারে। কিন্তু এখন যেন লুটপাট হচ্ছে প্রকাশ্যে। এক সপ্তাহ লুটপাট হলে অভিযান হয় একদিন আর ওইদিন বাদে বাকি ছয়দিনই চলে এই লুটপাট। যেদিকে পাথর কেনা-বেচা হয় এবং গাড়ি বা বড় নৌকা করে পাথর যায়, সেদিকে অভিযান না হওয়াতে এই লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেছেন, “প্রশাসনকে আমি সাদা পাথর রক্ষার্থে ব্যর্থ বলবো না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো, যখন চেষ্টা করতো। সাদা পাথর রক্ষার্থে তো তারা কখনও কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রশাসনের উদাসীনতাই সাদা পাথরের জন্য কাল হয়েছে। অথচ এক বছর আগেও সাদা পাথরে কেউ হাত দেওয়ার সাহস পায়নি।” সিলেটের ডিসি বলেছেন, “সাদা পাথর রক্ষার্থে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই লুট বন্ধ হচ্ছে না।”
অবশ্য বাংলাদেশে বড় অপরাধ ও দাগি আসামি প্রায় সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। অথচ ছোট ছোট অপরাধের জন্য দরিদ্র মানুষ শাস্তি পান। আমরা ভুলে যেতে বসেছি খেটে খাওয়া লজ্জার কিছু নয়। বরং চুরি করা, মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা, ভণ্ডামি ও জনগণের করের টাকা পকেটস্থ করাটা অনেক বেশি লজ্জার। একই দেশ, একই সমস্যা অথচ মানুষের জীবনবোধ ও সমস্যার কত ফারাক, কতটা বৈপরীত্য। অথচ এই দেশেই এমন একটা ভোগবাদী শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা শুধু খাই খাই করছে। এভাবে খেতে খেতে তারা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করছে, নীতি-নৈতিকতাকে কবর দিচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করছে, বাজার ব্যবস্থাকে অসম করে তুলেছে, ঘুষ, দুর্নীতির চর্চা করে নিজেদের উদরপূর্তি করছে এবং সেইসাথে সমাজের একটা বড় অংশকে অসাধু করার ফাঁদ পেতে চলেছে। এ একটা ভয়াবহ চক্র।
বিভিন্ন পক্ষ থেকে বহু বছর ধরে বলা হচ্ছে যে দেশের প্রাকৃতিক বনভূমি এবং নদীগুলোর দখল একটি গুরুতর সমস্যা, যা দেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। এই দখল কেন ঘটছে এর পেছনে নানাধরনের কারণ থাকলেও মূল কারণ লোভ, দুর্নীতি ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা।
পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বিবিসি বাংলাকে এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘‘ প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা স্বচ্ছ পানির এ আধার এই এলাকার বেশ কিছু স্থানের খাবার পানির চাহিদা মেটায়।
“প্রথম গুরুত্ব হচ্ছে এই পাথরগুলো যেখান থেকে ন্যাচারালি আসে, ওইখান থেকে পানি প্রবাহের ভয়ঙ্কর রকম তোড় তৈরি হয়। মানে পানি প্রবাহের তীব্রতা বেড়ে যায়। যেখানে তোড় বেশি সেখানে পাথর জমে। পাথরের কাজ হয় ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করে তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা একটা প্রাকৃতিক ধাপ” বলেন মি. হাবিব।
শুধু তাই নয় পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও এর কাজ যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’ বলা হয় বলে জানান মি. হাবিব।
প্রকৃতির এই পুরো সিস্টেমে যদি কোন ব্যাঘাত ঘটানো হয় অর্থাৎ পাথর তুলে ফেলা হলে তখন সিস্টেম ভেঙে পড়ে বলে জানান এই পরিবেশবিদ।
“এর ফলে দু’পাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়ে, ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পানিটাকে গোড়াতেই সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলে। মনে রাখা দরকার ওই অঞ্চলের অনেক জায়গায় খাবার পানির স্বল্পতা মেটায় এই পানি” বলেন মি. হাবিব।’’
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারির সহায়তায় বনভূমিকে কৃষিজমি বা বাসস্থানে রূপান্তরিত করছে। মধুপুরে সাল ফরেস্টে হোমস্টেড গার্ডেন এবং ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে বনভূমি দখল হচ্ছে। এছাড়া বনভূমি থেকে অবৈধভাবে কাঠ কাটা এবং বিক্রি করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে মেগা প্রকল্প গ্রহণ, জুমের জমি দখল, আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ নতুন কোন ঘটনা নয়। তবে বনভূমি দখলের এই হার প্রকৃতি ও প্রাণিজগতকে দারুণভাবে বিপর্যস্ত করছে।
এছাড়া বাংলাদেশের নদী, যেমন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী এবং অন্যান্য অনেক নদী দখলের কারণে সংকুচিত এবং দূষিত হচ্ছে। নদীর তীরে অবৈধ নির্মাণ, বাসস্থান, শিল্পকারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে নদী সংকুচিত করা হচ্ছে। শিল্পকারখানা থেকে দূষিত পানি এবং আবর্জনা ফেলে নদী ভরাট করা হচ্ছে, যা নদীর প্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে।
যাক ফিরে আসি পর্যটন কেন্দ্রের প্রশ্নে। সেন্টমার্টিনের মতো অসাধারণ সুন্দর ও জনপ্রিয় একটি ট্যুরিস্ট স্পট এখন আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেন্টমার্টিন কেন, কীভাবে হাতছাড়া হলো সে আলোচনায় না গেলেও বলা যায়, পর্যটকদের নির্বিচার “সৌন্দর্য দর্শন” এই রেসিট্রিকশন আরোপের অন্যতম একটি কারণ।
একই অবস্থা হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। পর্যটন ব্যবসাকে যেমন-তেমনভাবে অর্থ আয়ের উপায় করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই হাওড় এলাকা এবং এখানকার প্রাণীকুল। সুন্দরবনে একদিকে চোরা শিকারি ও বন খেকোদের দাপট, অন্যদিকে পর্যটকবাহী ট্রলার ও লঞ্চগুলোর যথেচ্ছভাবে যাতায়াত, শব্দ ও পানিদূষণ চলছেই। সুশাসন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে, বন্যা বৃদ্ধি, মাটি ক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আরও দ্রুত হারিয়ে যাবে। আর সেই সাথে হারিয়ে যাবে আমাদের বেড়ানোর জায়গাগুলো।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বনভূমি এবং নদী দখলের বিষয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে এই সমস্যার কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে অনেক কারণ উল্লেখ করা হয়। তবে মূল কারণ একটাই মানুষের খাদক রূপ বা সবকিছু খেয়ে ফেলার প্রবণতা।
মাঝেমধ্যে মনে হয় এইসব দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের সন্তান কীভাবে বড় হয়, তারা কি কোনদিনও বাবা বা মায়ের লোভী দিকটা দেখতে পারে? তারা কি বাবা মাকে শুধরানোর চেষ্টা করে? যেদিন তারা বুঝতে পারবে, সেদিন হয়তো দেখবে তাদের বাবা-মায়ের অবস্থাও চিহিরোর মতো হয়ে গেছে।
অনেকেই চিহিরোর বাবা-মায়ের মত শুধু গোগ্রাসে খাচ্ছে, খাবার, বাড়ি গাড়ি, জমি, টাকা, মানুষ। তারা ভুলে গেছে মানুষের মনে লজ্জা, ভয়, কল্পনা, রুচি, স্বপ্ন, আদর্শ, চরিত্র, নাগরিকবোধ, সদাচারণ, সৃজনশীলতা, সম্মানবোধ, মর্যাদা, পরিস্থিতি বিবেচনা, কমিউনিটি ফিলিংস, সৃজনশীলতার মতো অনেক পজিটিভ ইমেজ থাকে, শুধু ভোগ করাই থাকে না।
১৩ আগস্ট, ২০২৫
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস