Google Alert – সেনাপ্রধান
প্রধান উপদেষ্টা ড. প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করার সাথে সাথে সারা দেশে একটি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। বলা যেতে পারে, নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। অন্য দিকে বিভিন্ন দলের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক প্রার্থীরা যার যার এলাকায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। আর বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ভোট দিতে না পারা ভোটাররা যেন আনন্দিত হয়েছেন। বিশেষ করে সেসব তরুণ ভোটার যারা জীবনে প্রথম ভোট দিতে দীর্ঘকাল ধরে অপেক্ষায় আছেন।
এ দিকে এরকম একটি নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া সত্তে¡ও কেউ কেউ নির্বাচন না-ও হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। কিন্তু এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশের ভিত্তিটা এখনো অস্পষ্ট। তবে এটি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে যেটি ২০০৭ সালে সংঘটিত হয়েছিল। যে ঘটনা আমাদের দেশে ‘এক-এগারো’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় বিঘœ ঘটানো হয়েছিল।
ওই ঘটনা মূলত গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ করে দেয়, যা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, এক-এগারোর সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ, যা ভারতের মদদপুষ্ট একটি শাসন দেড় দশক ধরে নির্বিঘেœ ও নিরাপদে চলেছে। যদি ছাত্র-জনতার বিপ্লব না ঘটত তাহলে হয়তো ওই শাসনের অবসান না-ও হতে পারত। এ ক্ষেত্রে এটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সেই সময় খুব পরিকল্পিতভাবে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে অনিশ্চিত করে তোলা হয়েছিল। নিশ্চয় অনেকের মনে আছে, ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনার আহ্বানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সেই লগি-বৈঠার সন্ত্রাসের কথা। এ সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্য ছিল নির্বাচন বানচাল করে আওয়ামী লীগের সুবিধামতো সময়ে নির্বাচন করা। আর সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউও সে পথ ধরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে সেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, জরুরি অবস্থা ঘোষণার কিছুদিন পর জেনারেল মঈন ইউ দিল্লি সফরে গেলে তাকে ছয়টি ঘোড়া উপহার দেয়া হয়েছিল। প্রাচীন ভারতে অন্য রাজ্যের কোনো রাজাকে ঘোড়া উপহার দেয়া হতো বশ্যতার নিদর্শন হিসেবে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং শেখ হাসিনার নির্বিঘেœ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসন প্রমাণ করে সেই বশ্যতার ধারাবাহিকতা। এক-এগারোর মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় আনা। এক সেনাশাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ পঁচাত্তর-উত্তর বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে সহায়তা করেছিলেন। আরেক সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘমেয়াদে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। কারণ এটি হচ্ছে গণবিপ্লবে ফ্যাসিবাদের পতন-উত্তর একটি পরিবেশ, যা বাংলাদেশের মানুষকে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন করে তুলেছে। বিশেষ করে সেই তরুণসমাজ যারা বর্তমানে স্কুল, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত রয়েছেন। এই ইন্টার জেনারেশন ফ্যাসিবাদবিরোধী এমন একটি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যারা আগামীতে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র সৃষ্টির স্বপ্ন দেখছে। এই তরুণশক্তি ভবিষ্যতের নেতা। তারা আর কখনো ফ্যাসিবাদী শাসনে ফিরে যাবেন না, কাউকে যেতেও দেবেন না।
যদিও ইতোমধ্যে এসব তরুণ একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে কিছুটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। কারণ তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। এর বিরুদ্ধে সোস্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইছে। এসব সমালোচনার ধরন দেখে মনে হচ্ছে দু-একজন তরুণের এ চাঁদাবাজি ফ্যাসিবাদী শাসনকালের হাজার হাজার চাঁদাবাজ কিংবা বর্তমানে কোনো কোনো বৃহৎ দলের চাঁদাবাজদের থেকে ভয়ঙ্কর! মূলত নবউত্থিত এ তরুণশক্তিকে কায়েমি স্বার্থের ধারক রাজনীতিবিদরা সহজে মেনে নিতে পারছেন না। যদিও পুরনোরা নতুন কিছু সহজে মেনে নিতে পারেন না। তাই হয়তো তারা শুরুতে এ তরুণদের মনোবল ভেঙে দিতে চান। সুতরাং ওই ধরনের সমালোচনাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বললে ভুল বলা হবে না।
তবে নাগরিক সমাজের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষকে এটি উপলব্ধি করতে হবে, এ তরুণ ছাত্রদের অধিকাংশ গ্রাম কিম্বা শহরের মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। তারা সংখ্যায় লাখ লাখ। সুতরাং এ অগণিতসংখ্যক তরুণের দু-একজনের মধ্যে লোভ থাকবে না সেটি আমরা কী করে বলি। আর দু-একজনের চাঁদাবাজি বা দুর্নীতির কারণে ইন্টার জেনারেশনকে আমরা অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করাব- এটি কি কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে? যদি তারা ভুল করে, তবে তাদের সঠিক পথ দেখানো মুরুব্বিদের কাজ। আর এ রাজনৈতিক মুরুব্বিরা সে কাজটি না করে যদি হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ঘৃণা করে তাদের দূরে সরিয়ে দেন, তাহলে সেটি হবে অদূরদর্শী একটি কাজ। যেমন করে শেখ হাসিনা তার ঘৃণ্য রাজনৈতিক স্বার্থে এ তরুণদের কথা বুঝতে চেষ্টা করেননি; বরং তিনি রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিপূজার উপাখ্যান এ তরুণদের ওপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এ জবরদস্তিমূলক বিষয়টি শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত বুদ্ধি বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। লেবু যেমন বারবার কচলালে তেতো হয়ে যায়, এ ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছিল।
যা হোক, আবার ফিরে আসা যাক নির্বাচন প্রসঙ্গে। এবার দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে, প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে অসাধারণ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে : ঘটনাপ্রবাহকে নিজেদের দিকে নিয়ে যেতে যে দলটি সবধরনের সহিংসতা সৃষ্টি করতে সক্ষম; সেই দলটির অনুপস্থিতি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নেই। নিশ্চয় ’৯৬ সালের কথা অনেকের মনে আছে। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে সে সময় আওয়ামী লীগ সারা দেশে এমন এক সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, যা নির্বাচনের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল। তখন সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল, আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলে দেশ আবারো অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে দলটি যেকোনো পন্থা অবলম্বনে পারদর্শী। কিন্তু এবার দলটির রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ থাকায় নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকবে। তাই অনেকে ভাবছেন আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে দু’টি কারণে পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রথমত, আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যদি সংগঠিত হয়ে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। পাশাপাশি যদি বিএনপি নেতাকর্মীরা দলের ভেতরকার দ্ব›েদ্ব অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয় ও বেপরোয়া চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখে- তাহলে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়লে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।