জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে হত্যা করা হয় মেজর জাহিদকে

Google Alert – সেনা

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ভারতের সম্পৃক্ততার তথ্য জানার অপরাধে আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গি নাটক সাজিয়ে মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামকে হত্যা করে। মেধাবী ও চৌকশ সেনা কর্মকর্তা জাহিদুলকে হত্যার মধ্যেই দানবীয় ওই সরকারের খেদ মেটেনি। সরকার মেজর জাহিদের পরিবারকেও নিশ্চিহ্ন করতে সব রকমের চেষ্টা করে। অসহায় পরিবারটির ওপর নেমে আসে অমানবিক, নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম নির্যাতন।

জঙ্গি নাটক করে মেজর জাহিদের ন্যায় তার অসহায় বিধবা স্ত্রী জেবুন্নাহার ইসলাম ও এতিম দুই কন্যাশিশুকে ডিবির আয়নাঘরে চোখ বেঁধে ৪ মাস ৭ দিন গুম করে রাখা হয়। জেবুন্নাহারের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে চলে মধ্যযুগীয় নির্যাতন। তাকে হুমকি দেওয়া হয়, তিনি যেন তার স্বামীকে জঙ্গি বলে আদালতে স্বীকার করেন। তা না হলে জেবুন্নাহার ও দুই মেয়েকে তার স্বামী জাহিদের মতোই পরিণতি ভোগ করতে হবে। তিনি মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বারবার অপারগতা প্রকাশ করেন। এভাবে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি না পেয়ে তার বড় মেয়েকে গ্রেফতার করে তাকেও নির্যাতন শুরু করা হয়। মেজর জাহিদের মেয়েকে গ্রেফতারের সময়ও কথিত জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। আজিমপুরের একটি বাসা থেকে তাকে জঙ্গি হিসাবে উদ্ধার দেখানো হয়। পরে তাকে কিশোর ভিকটিম সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।

২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসা থেকে মেজর জাহিদকে ধরে বাসার নিচে এনে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়। এর এক ঘণ্টা আগে তার পরিবারের সদস্যদের জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ওই বাসা থেকে উদ্ধার দেখানো হয়। তারপর তাকে ডিবি কার্যালয় নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে। নেওয়া হয় মিথ্যা জবানবন্দি। একই সঙ্গে নিহত মেজর জাহিদের ১টি মামলা ও তার স্ত্রী জেবুন্নাহারের বিরুদ্ধে ২টি সাজানো জঙ্গি মামলা দেওয়া হয়। ওই সরকার তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে নাটকের পর নাটক করতে থাকে। তাকে প্রথম দফায় ডিবির আয়নাঘরে বন্দি রাখা ও নির্যাতন করার পর আবারও নতুন গল্প তৈরি করে। জেবুন্নাহার যখন কাশিমপুর কারাগারে তখন তাকে আশকোনার একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার দেখায়। এই উদ্ধারের ১৬ দিন পর তাকে ফের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়।

তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা তিনি দেখেছেন। কিন্তু নিষ্ঠুর কায়দায় তাকে হত্যার ঘটনা জানতে দেওয়া হয়নি। গ্রেফতারের পরে জানতে পারেন, বাসা থেকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর জাহিদকে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে চলে যায় দীর্ঘ চার বছর। তিনি জামিন পেলেও এর দুই বছর পর আবার জামিন বাতিল করে দেওয়া হয়। জামিনে থেকে স্বামী হত্যার বিচার চাইতে পারেন-এমন সন্দেহ থেকে তার জামিন বাতিল করে ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশে ফের কারাগারে পাঠানো হয়।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন না হলে হয়তো জেবুন্নাহারকে ধুঁকে ধুঁকে জেলখানায় মরতে হতো অথবা তাকে বড় ধরনের শাস্তির মুখোমুখি করা হতো। ওই বছর (২০২৪) ৩১ আগস্ট তিনি জামিনে মুক্তি পান। ডিবি হেফাজতে নির্যাতন, আয়নাঘর এবং জেলজীবনের করুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে জেল থেকে জামিনে বের হন।

জেবুন্নাহারের ভাই জাহিদুল হক মজুমদার শনিবার যুগান্তরকে বলেন, নিহত জাহিদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে দীর্ঘদিন পড়ে ছিল। লাশ নিতে চাইলেও পরিবারের কাছে দেওয়া হয়নি। আড়াই বছর পর বেওয়ারিশ হিসাবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে তার লাশ হস্তান্তর করলে অনেক কষ্টে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

জেবুন্নাহার ইসলাম বলেন, আমার স্বামী শহীদ মেজর জাহিদুল ইসলামকে হত্যার পর আমার ওপর নেমে আসে অমানবিক, নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম নির্যাতন। আসামিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার স্বামীকে জঙ্গি তকমা দিয়ে হত্যা করা করা হয়। আমি এর বিচার চাই।

জেবুন্নাহারের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন বলেন, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম ঘটনার একটি মেজর জাহিদকে হত্যা। মূলত বিডিআর বিদ্রোহে আওয়ামী লীগ ও ভারতের সম্পৃক্ততা জেনে যাওয়ায় মেজর জাহিদকে হত্যা করা হয়।

এদিকে, চলতি বছরের ২৭ জুলাই গুম কমিশন এবং পরে ১০ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর পৃথক দুটি অভিযোগ দায়ের করেন জেবুন্নাহার। অভিযোগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হক, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তৎকালীন প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) তৎকালীন প্রধান মো. আসাদুজ্জামান, মিরপুর বিভাগের তৎকালীন উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আহমেদ, রূপনগর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীদ আলম, ডিসি ডিবি কৃঞ্চ পদ রায় ও রূপনগর থানা-পুলিশের তৎকালীন অজ্ঞাতনামা সদস্যদের আসামি করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন জানায়, সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামকে হত্যার বিষয়ে তারা একটি অভিযোগ পেয়েছেন। সেটি এখন তদন্ত পর্যায়ে আছে।

প্রসঙ্গত, মেজর জাহিদুল ইসলাম ২০০০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৩তম বিএমএ লং কোর্স থেকে কমিশন পান। তার কোর্স পজিশন ছিল তৃতীয় এবং তিনি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গোল্ড মেডেল অর্জন করেছিলেন। চাকরি জীবনে তিনি কঙ্গোতে শান্তিরক্ষা মিশন, পাকিস্তানে মিড ক্যারিয়ার কোর্স, স্টাফ কলেজ পাশ করে কানাডায় উচ্চতর কোর্স সম্পন্ন করেন। সিলেট এবং বগুড়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনসহ সুদীর্ঘ সুনামের ইতিহাস রয়েছে তার।

ট্রাইব্যুনালে করা অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে সরকারের বাছাইকৃত সেনা কর্মকর্তাদের পিলখানায় পোস্টিং দেওয়া হয় এবং সেই তালিকায় মেজর জাহিদেরও নাম ছিল। জাহিদ পোস্টিংয়ে আগ্রহী ছিলেন না। তাই যোগদান করেননি। তখন পিলখানায় জাহিদের কোর্সমেট শহীদ ক্যাপ্টেন মো. মাজহারুল হায়দার পিলখানায় পোস্টিং ছিল। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের ওপর এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ঘটনার দিন শহীদ ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দার জাহিদকে ফোনে বলেছিলেন, আমাদের সব অফিসারকে মেরে ফেলেছে। কারা মেরেছে মেজর জাহিদ জানতে চান। তখন ক্যাপ্টেন মাজহার বলেন, কিছু হিন্দিভাষী ব্যক্তি, যারা বিডিআরের পোশাক পড়াছিল। যাদের কখনোই পিলখানায় আগে দেখিনি। মেজর জাহিদ তখন বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। ঘটনা শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে বিষয়টি জানান। জাহিদ পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে মাজহারুলের কাছ থেকে অনেক কিছুই জেনে গিয়েছিলেন। তাই ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার মেজর জাহিদুল ইসলামকে (অব.) টার্গেট করে নজরদারিতে রাখত।

অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, সেনাবাহিনীতে অযোগ্য অফিসারের পদোন্নতি এবং নানা বিশৃঙ্খলা জাহিদ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে তিনি দেখলেন, চাটুকার ও অযোগ্য অফিসারদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি ২০১৫ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে উত্তরায় ভাড়া বাসায় উঠেন।

এদিকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর গোয়েন্দারা জাহিদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি শুরু হয়। একপর্যায়ে পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জাহিদ। বাসা বদল করে উত্তরা থেকে রূপনগরে চলে যান। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার সূক্ষ্মভাবে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে জাহিদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সেই মোতাবেক, ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে জাহিদুল ইসলামকে হাত বেঁধে বাসার নিচে নিয়ে যায় রূপনগর থানা পুলিশের একটি দল। তারপর নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে রাত আনুমানিক ১০টার দিকে আসামিরা জেবুন্নাহারকে তার দুই শিশুসন্তানসহ চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন হাসিনার খুনি বাহিনী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন তিনি জানতে চান, তার স্বামী কোথায়? পুলিশ তখন বলতে থাকে, তিনি ও তার স্বামী জঙ্গি, এই স্বীকারোক্তি না দিলে তাকেও তার স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন তিনি বুঝতে পারেন, তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। পরে পুলিশের কোনো একজন বলেন, তারাই মেজর জাহিদকে হত্যা করেছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *