দেশ রূপান্তর
কিছুদিন আগে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগের পর এবার দেশ ভাগের ইতিহাস ঘিরে ভারতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। দেশটির স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে; অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের ঘোষণায় ২০২১ সাল থেকে ১৪ আগস্ট ‘বিভাজন বিভীষিকা স্মৃতি দিবস’ হিসেবে পালিত হয় ভারতে। উদ্দেশ্য, স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত সেই কালো অধ্যায়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যখন দেশ ভাগের আগুনে লাখ লাখ মানুষ শিকড়হীন, বাস্তুচ্যুত ও নিঃস্ব হয়েছিল। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ ‘মডিউলে’ দেশ ভাগের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ উঠছে ভারতের জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পরিষদের (এনসিইআরটি) বিরুদ্ধে। এনসিইআরটির প্রকাশিত সাম্প্রতিক মডিউলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশ ভাগ কোনো একক নেতার কাজ ছিল না। তিনটি প্রধান শক্তি একত্রে কাজ করেছে জিন্নাহ যিনি পাকিস্তানের দাবি তুলেছিলেন, কংগ্রেস যারা অবশেষে বিভাজন মেনে নিয়েছিল এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন, যিনি তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এ নতুন পাঠ্য অধ্যায় প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়েছে। এর আগেও এনসিইআরটির বিরুদ্ধে একাধিকবার স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে। কিছুদিন আগেই মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বদলের অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। এবার ষষ্ঠ-অষ্টম এবং নবম-দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য প্রকাশিত বিশেষ মডিউলে ভুল ইতিহাস পড়ানোর অভিযোগে শোরগোল পড়েছে গোটা ভারতে। এই মডিউলে ছাত্রছাত্রীদের জানানো হবে, কীভাবে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের বিভাজন সাধারণ মানুষের জীবনে অমানবিক দুর্ভোগ নামিয়ে এনেছিল এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে গণতান্ত্রিক সমাজকে কী শিক্ষা নিতে হবে। ইংরেজি এবং হিন্দি, দুই ভাষাতেই প্রকাশ করা হয়েছে বিতর্কিত মডিউলটি।
এনসিইআরটির মডিউল
এনসিইআরটির এ বিশেষ মডিউলটির যে অংশটি নিয়ে বিতর্ক, তার নাম ‘দেশ ভাগের অপরাধী’। সেখানে বলা হয়েছে, দেশ ভাগ কোনো একক পক্ষের সিদ্ধান্তে সম্পন্ন হয়নি। বরং তিনটি সম্মিলিত শক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়। যেখানে জিন্নাহ দেশ ভাগের ভাষ্য তৈরি করেছিলেন; কংগ্রেস দেশ ভাগ মেনে নিয়েছিল এবং মাউন্টব্যাটেন যিনি এর বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন। মডিউলের দাবি, ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন ভারতের পক্ষে ছিল, তবে বিভক্ত ভারতের নয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন মর্যাদা’ দেওয়া, অর্থাৎ নামমাত্র রাজা থাকবেন ব্রিটিশ, কিন্তু প্রশাসন চলবে ভারতীয়দের হাতে। প্রদেশগুলোকে দেওয়া হয়েছিল ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত বা বিচ্ছিন্ন থাকার বিকল্প। কিন্তু কংগ্রেস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। দেশের বড় নেতাদের মধ্যেও দেশ ভাগ নিয়ে ছিল বিভাজিত মতামত। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রথমে দেশ ভাগের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির চাপে তা গ্রহণ করেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একটি উক্তিও তুলে ধরে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নেহরুর বক্তব্যের যে অংশ তুলে ধরা হয়েছে; তাতে বলা হয় আমরা এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, যেখানে হয় বিভাজন মেনে নিতে হবে, অথবা সংঘাত এবং বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকবে। দেশ ভাগ খারাপ, কিন্তু ঐক্যের চেয়েও গৃহযুদ্ধের মূল্য আরও বেশি হবে। ১৯৪০ সালের লাহোর চুক্তির উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, জিন্নাহ বলেছিলেন হিন্দু ও মুসলিমরা দুই পৃথক গ্রামের বাসিন্দা। তাদের দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি, সাহিত্য সব আলাদা। অন্যদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেন, আমি ভারত ভাগ করিনি, ভারতীয় নেতারাই অনুমোদন করেছিলেন। আমি শুধু বাস্তবায়ন করেছি। মহাত্মা গান্ধী দেশ ভাগের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে তিনি বলেন, কংগ্রেস দেশ ভাগ মেনে নিলে তা আমার পরামর্শের বিরুদ্ধে হবে। তবে আমি হিংসার সঙ্গে এর বিরোধিতা করব না। অবশেষে নেহরু ও প্যাটেল গৃহযুদ্ধের ভয় থেকে দেশ ভাগে সম্মতি দেন। গান্ধীজিও আর প্রতিবাদে অনড় থাকেননি। ১৪ জুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তিনি অন্য নেতাদেরও দেশ ভাগে রাজি করান। দেশ ভাগের ‘দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতি’ বর্ণনা করতে গিয়ে এনসিইআরটি দাবি করেছে, আজও বাইরের শত্রুর আঘাত সহ্য করতে হচ্ছে ভারতকে। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক বিভাজন বয়ে চলেছে ভারত। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও শত্রুতা, সন্দেহের পরিবেশ রয়েছে, যার দরুন দেশ ভাগ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এনসিইআরটি দেশ ভাগকে সরাসরি কাশ্মীর সংকটের জন্য দায়ী করেছে। সেই সঙ্গে দেশ ভাগের জন্যই বিদেশি শক্তিরা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে এবং ভারতের ওপর চাপ বাড়িয়েছে, যার দরুন ভারতকে সামরিক ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে এবং বিদেশনীতিতেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়ে গেছে বলে দাবি তাদের।
কংগ্রেসের প্রতিবাদ
এ বিতর্কে আবারও এনসিইআরটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষার্থীদের ভুল ইতিহাস পড়িয়ে এনসিইআরটির মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীদের। বিশেষ মডিউলটি সামনে আসতেই এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে কংগ্রেস। এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মুখপাত্র পবন খেরা বলেন, এ তথ্য পুড়িয়ে ফেলা উচিত। কারণ এটা সম্পূর্ণ অসত্য। হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের আঁতাতের জন্যই দেশ ভাগ হয়েছে। আরএসএস দেশের জন্য বিপজ্জনক। ১৯৩৮ সালে হিন্দু মহাসভাই প্রথম দেশ ভাগের ভাষ্য তৈরি করে। ১৯৪০ সালে সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটান জিন্নাহ। একে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ’ বলে আখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ইতিহাসকে বিকৃত করে কংগ্রেসের ভূমিকা ছোট করা হচ্ছে এবং বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক মতাদর্শকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর আগে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আরএসএসের ভূমিকা, নাথুরাম গডসের সংস্রব, কিংবা গুজরাট দাঙ্গার মতো অধ্যায় পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সমালোচকদের মতে, এর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু মৌলবাদী শক্তিকে দায়মুক্ত করা। এবারে দেশ ভাগের দায় সরাসরি কংগ্রেসের ঘাড়ে চাপানোয় তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মহলেও এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বহু ইতিহাসবিদ মনে করেন, দেশ ভাগ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি, মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের সমন্বিত ফল। কিন্তু এনসিইআরটির এই একতরফা বিশ্লেষণ ভারতের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করছে। বিদেশি গবেষকদের দৃষ্টিতে এটি প্রমাণ করছে, ভারতে শিক্ষা ও ইতিহাসকেও ভোট রাজনীতির চাপে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতের সংবিধান নিজেকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি ও আরএসএস যেভাবে ইতিহাসের অধ্যায় পরিবর্তন করছে, তা কি সেই ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে এভাবেই বিজেপি তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ফলে তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমেই কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে, যেখানে প্রশ্ন উঠছে ভারত কি সত্যিই একটি উদার গণতন্ত্র হিসেবে থেকে যাচ্ছে নাকি শিক্ষা-ইতিহাসও দলীয় মতাদর্শের শিকার হচ্ছে। এ বিতর্কের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হচ্ছে, শুধু ইতিহাস নয়, ভারতের রাজনৈতিক বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েও এক ধরনের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। দেশ ভাগের দায় নিয়ে মডিউলের এ বিতর্ক হয়তো পাঠ্যক্রমের সীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা ভারতের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।
মোগল সাম্রাজ্য নিয়ে বিতর্ক
২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে ভারতের জাতীয় শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ (এনসিইআরটি) অষ্টম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান পাঠ্যবইতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে, যা দেশটিতে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। নতুন পাঠ্যবইয়ে মোগল সম্রাট বাবর, আকবর ও আওরঙ্গজেবকে জ্ঞান-সাহিত্যের অনুরাগী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, তাদের একই সঙ্গে নৃশংস শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যারা লুটপাট, দাস বানানো এবং বলপ্রয়োগে ভারতীয় জনগণের ওপর শাসন কায়েম করেছিল। যেখানে এক সময় আকবরকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হতো, সেখানে এখন তাকে মন্দির ভাঙা এবং বেসামরিক মানুষ হত্যাকারী হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যদিও পরে তার শান্তির দিকে ধাবিত হওয়ার প্রসঙ্গ খুব সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাবরের কবিতা ও স্থাপত্যপ্রেমের উল্লেখ থাকলেও তার দখলদারির নৃশংসতা প্রধান করে তোলা হয়েছে। আওরঙ্গজেবকে দেখানো হয়েছে মন্দির ধ্বংস এবং ধর্মীয় নিপীড়নের প্রতীক হিসেবে। প্রসঙ্গত, ‘এক্সপ্লোরিং সোসাইটি : ইন্ডিয়ান অ্যান্ড বিয়ন্ড’ নামের বইটিতে রয়েছে সতর্কীকরণও। সেখানে বলা হয়েছে, ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়গুলো সম্পর্কে তথ্য এখানে দেওয়া হলেও, অতীতের ঘটনার জন্য আজকের কাউকে দায়ী করা যায় না। শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, ইতিহাস চাইলেই পরিবর্তন করা যায় না। আর তেমনটা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যা হবে ভয়াবহ। কেননা, তারা ইতিহাসের গতিপথ থেকেই বিচ্যুত হবে এবং সঠিক ইতিহাস জানা ও ধারণ করা থেকে বঞ্চিত হবে।