Samakal | Rss Feed
জনগণ রুখে দাঁড়ালে লুটেরা চক্র টিকতে পারে না
বাংলাদেশ
সমকাল প্রতিবেদক 2025-08-17
সিলেটে পাথর লুটপাটের বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জনগণের শক্তিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। রাজনৈতিক সমর্থন যতই থাকুক, জনগণ যদি রুখে দাঁড়ায়, লুটেরা চক্র টিকতে পারে না। রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, পাথর ইজারা দেওয়ার দায়িত্ব খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের, আর বালুর ইজারা ভূমি মন্ত্রণালয়ের। তবে উভয় কাজই জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
উপদেষ্টা জানান, ২০১১ সালে হাইকোর্টে একটি রায়ের মাধ্যমে পিয়াইন ও ডাউকি নদীকে (যা জাফলং এলাকায় অবস্থিত) ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ২০১৯ সালে সরকার ওই এলাকা ইসিএ ঘোষণা করে। এর পর থেকে ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সেখানে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। আমি নিজেই ওই মামলার বাদী ছিলাম। পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের কারণেই সরকার ১৭টি পাথর কোয়ারি ইজারা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রশাসন মাঠপর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় লুটপাট অব্যাহত থাকে।
গত এপ্রিলে পরিবেশ ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মাঠে গিয়ে পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন। ফিরে আসার সময় তাদের গাড়িতে হামলা হয়।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, আমরা ফিল্ডে গিয়েছিলাম বার্তা দিতে যে, সরকার চুপচাপ বসে নেই। আপনি আমাকে বলেন তো গত ১০-২০ বছরে পাথর লুটের বিরুদ্ধে কোনো মন্ত্রীকে স্পটে যেতে দেখেছেন? একটা উদাহরণ আমাকে দেন। কোনো মন্ত্রীকে আক্রান্ত হতে দেখেছেন একটা উদাহরণ আমাকে দেন।
উপদেষ্টা অভিযোগ করেন, পাথর লুটে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেই ঐক্যটার বিপরীতে প্রশাসন হয়তো যোগসাজশ করেছে, নতুবা নীরব থেকেছে বা দুটোই করেছে। সেজন্য প্রশাসনের ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নেব কিনা, দ্রুতই দেখতে পাবেন। তবে জনগণের প্রতিবাদেই লুটেরা গোষ্ঠী চাপে পড়েছে।
তিনি বলেন, আজকে যারা শ্রমিকদের দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করছে, তারাই আগে ডিনামাইট মেশিনে পাথর তুলতে গিয়ে বহু শ্রমিককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। শুধু জাফলংয়ে ৬৫ থেকে ৮০ জন শ্রমিক মারা গেছেন।
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, সরকারের কাজ নীতিমালা প্রণয়ন করা, আমরা কিন্তু সেই নীতিটি ঠিকই প্রণয়ন করেছি, যে এই ১৭টিতে পাথর উত্তোলন করা যাবে না। পাথর আদৌ উত্তোলন হচ্ছে কিনা এটি দেখবে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন। আমরা কিন্তু বারবার প্রশাসনকে বলেছি, লিখেছি। আমি যখন দেখলাম প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না, তাদের সাহস দেওয়ার জন্য আমি এবং ফাওজুল ভাই (উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান) দুজনই ফিল্ডে গেলাম। যখন আমরা ফেরত আসলাম তখন আমাদের গাড়ি ঘিরে যে অশ্লীল বিক্ষোভ প্রদর্শন করল এবং পরে সেই বিক্ষোভের জের ধরে একটি রাজনৈতিক দল নেতাদের বহিষ্কার এবং সাসপেন্ডও করল; সেই সময় যদি প্রতিবাদটা খুব জোরালো হতো না, তাহলে আজকের পরিস্থিতিটা ভিন্ন হতো।
তিনি আরও বলেন, যা হোক ‘বেটার লেট দেন নেভার’। আমি জনগণকে ধন্যবাদ জানাই তারা যে লোকেরা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদটা করেছে। যার ফলে আজ যে অবস্থাটা সৃষ্টি হয়েছে এতে ভবিষ্যতে পাথর লুটবার আগে দুইবার চিন্তা করবে।
রিজওয়ানা হাসান আর বলেন, পাথর কতটুকু তুললো, লুট হলো, নিয়ে গেলো- এটি আমার মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু আমি একজন পরিবেশকর্মী এবং সরকারে আছি…আমি দায়িত্ব নেব। তবে পাথর লুট হয়ে যাওয়ার দায়টা আমাকে দিয়েন না। কারণ পাথর লুট ঠেকাতে আমি অনেক যুদ্ধ করেছি। এখন দেখা যাচ্ছে তারা মামলা করছে, সেখানে আদৌ যারা দোষী তাদের কতটুকু তালিকাভুক্ত করছেন, সেটা আমাদের দেখতে হবে।
পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা বলেন, যখন আমরা দুই উপদেষ্টা সেখানে গেলাম এবং আক্রান্ত হলাম। তারপর আমরা চলে আসলাম, তারপরে কিন্তু তিন দিনব্যাপী ব্যাপক অভিযান হলো। সব পাথর ভাঙার মেশিনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তার চার-পাঁচ দিন পর সব রাজনৈতিক দল এক হয়ে চাপ প্রয়োগ করা হলো, তারা সেখানে ঘোষণা দিলেন যে পাথর তুলতে দিতে হবে। পরিবহন মালিকরা বললেন যে তারা ধর্মঘট করবেন। এই ধর্মঘট কিন্তু তাদের নতুন নয়।
উপদেষ্টা আরও বলেন, যখন ২০২০ সালে পাথর তোলা বন্ধ করে দেওয়া হলো, সেই সময় করোনার মধ্যে তারা দুই দুইবার পরিবহন ধর্মঘট করেছেন। তাদের যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের জন্য বিন্দুমাত্র মায়া থাকতো করোনার এমন সংকটের মুহূর্তে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য ধর্মঘট ডাকতে পারতেন? সেই সময় আমরাও সোচ্চার ছিলাম, প্রশাসনকে আমাদের সঙ্গে আনতে পেরেছিলাম। এবার হলো কী- সর্বদলীয় ঐক্যের কথা যে আমি বলেছিলাম, সর্বদলীয় ঐক্যের কারণে প্রশাসন নিশ্চয়ই যোগসাজশে ছিল। তাহলে তারা এখন বের করতে পারে পাথরগুলো কোথায়? আবার নীরবতাও ছিল। তারা হয়তো অতটা ঝুঁকি নিতে পারছিলেন না।
উপদেষ্টা বলেন, আজ মানুষ তার শক্তি দেখিয়েছে। লুটেরা চক্রের বিরুদ্ধে যখন মানুষ দাঁড়িয়ে যায়, তখন যতই রাজনৈতিক শক্তি ওটাকে সাপোর্ট করুক না কেন, মানুষের শক্তিটাই আসলে জয়ী হয়ে আসবে।
তিনি জাফলং ও সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, আমি সিলেটের মানুষ। যে জাফলং আমি দেখেছি, আজকের প্রজন্ম তা দেখেনি। আমরা চাই, জাফলং আবার তার স্বাভাবিক রূপ ফিরে পাক।