Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment
ঢাকা: “পুড়ছে ছয় মরদেহ। নিজেদের ভ্যানে তুলেই আগুন দেয় পুলিশ। আর আগুনের তীব্রতা বাড়াতে তাদেরই এক সদস্য ছুড়ে মারেন কাঠের বেঞ্চ। যদিও হত্যার পরই এসব মরদেহ স্তূপ করে রাখা হয়। এই ছয়জনের একজন শহিদ আস-সাবুর। তাকেও পুড়িয়ে দেয় ‘পাষণ্ড’ পুলিশ সদস্যরা।” আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এমন দুটি ভিডিও প্রদর্শনের সময় অঝোরে কাঁদেন শহিদ আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি। এমনকি একইভাবে ‘খুনিদেরও’ শাস্তি চেয়েছেন তিনি।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সোমবার (১৮ আগস্ট) ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন এনাব। ১০ নম্বর সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিন সাক্ষীর ডায়াসে উঠেই নিজের পরিচয় দেন এনাব। এর পর ছেলের হত্যাকাণ্ডের পুরো বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি। জবানবন্দিতে আস-সাবুরের বাবা বলেন, ‘আমি শহিদ আস-সাবুরের বাবা। আমার ছেলে গতবছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে শহিদ হন। তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। এর পর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওইদিন সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে মিছিলে যায় আস-সাবুর। বেলা সাড়ে ১১টায় জামগড়া থেকে মিছিলটি বাইপাইলে আসে। ঠিক তখনই আমার বড় ছেলে রেজোয়ানকে মিছিলে আছে বলে সে ফোন দিয়ে জানায়। আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে ফের বড় ভাইকে কল দিয়ে জানায়- এখানে অনেক লোক গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে। ওই সময় তাকে সেখান থেকে চলে আসতে বলে রেজোয়ান। কিন্তু ছেলেটি এল না।’
মিছিলের সঙ্গেই বাইপাইল থেকে আশুলিয়া থানার দিকে যান আস-সাবুর। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সেখানে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছিল। গুলি থেকে বাঁচতে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। এরপর আর কোনো খোঁজ মেলেনি আস-সাবুরের। বিকেল ৪টার পর নিজের ব্যবহৃত মুঠোফোনটিও বন্ধ পান পরিবারের সদস্যরা।
সাক্ষী এনাব বলেন, “ওইদিন আমার ছেলে আর ফেরত আসেনি। পরদিন ৬ আগস্ট বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে তাকে অনেক খোঁজাখুজি করি। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আমার বড় ছেলেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক ইমরান বলেন, ‘আশুলিয়া থানার সামনে কয়েকটা পোড়ানো লাশ রয়েছে। সেখানে আপনার ভাইয়ের লাশ আছে কিনা এসে শনাক্ত করেন।’ এ কথা শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে রেজোয়ান। তখন আমার ভাগনে হুমায়ন কবিরকে ঘটনাস্থলে পাঠাই। তার সঙ্গে আমার দুঃসম্পর্কীয় খালাতো ভাই মেহেদী হাসানও ছিল। তারা পরনের টি-শার্টের পোড়া অংশ ও মোবাইলের সিমকার্ড দেখে আস-সাবুরকে শনাক্ত করে। লাশের সঙ্গে থাকা সিমকার্ডটি আরেকটি মোবাইলে সংযুক্ত করার পর দেখা যায় ওই নম্বরটি আমার ছেলে আস-সাবুরের।”
তিনি বলেন, ‘ওইদিনই সন্ধ্যা ৬টার দিকে পোড়ানো ছয়টি মরদেহের জানাজা পড়েন সেনাবাহিনী ও ছাত্ররা। এর পর মরদেহ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমার ভাই ও ভাগনে মিলে মরদেহটি আমার বাসায় নিয়ে আসেন। আমি আমার ছেলের মরদেহ দিকে একনজর তাকিয়েছি। কিন্তু চেহারা বীভৎস থাকায় তাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। পরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাত ৮টার দিকে আমাদের গ্রামের বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুরে নিয়ে যাই। ৭ আগস্ট সকাল ৯টায় তৃতীয় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।’
এ সময় ঘটনাটির জন্য দায়ী কয়েকজনের নাম বলেন আস-সাবুরের বাবা। তিনি বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নির্দেশে ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উসকানিতে আশুলিয়া থানার তৎকালীন ওসি, এসআই, কনস্টেবলরা আমার ছেলেকে হত্যা করে। ঢাকা উত্তরের উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহিল কাফী, ডিবির এসআই আরাফাত হোসেন, ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামদের সহায়তা ও মদদে এ হত্যাকাণ্ড চালায় পুলিশ। শুধু তাই নয়, আমার ছেলেসহ আরও পাঁচজনকে ভ্যানে তুলে পেট্রোল ও আগুনে পুড়িয়ে দেয় তারা। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার ও শান্তি চাই। যেভাবে আসামিরা আমার ছেলেকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, আমিও সে ধরনের শান্তি চাই।’
শহিদ আস-সাবুরের বাবা ছাড়াও শেখ হাসিনার মামলায় আরও দুজন সাক্ষ্য দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে একজন শহিদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল ও প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জন সাক্ষী নিজেদের জবানবন্দি দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২০ আগস্ট (বুধবার) দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।