Google Alert – ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দূরত্ব বাড়ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ দূরত্ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে গত ১৬ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে এনসিপি। সেখানে আগামী নির্বাচন গণপরিষদ নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার সমালোচনা করে মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, লন্ডনে সিজদা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ওহি এনেছেন। নির্বাচন হলে গণপরিষদ নির্বাচনই আগে দিতে হবে।
একই কথা বলেছেন দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, যাকে গণঅভ্যুত্থানের পরে সরকারপ্রধান বানানো হয়েছে উনি লন্ডনে গিয়ে সিজদা দিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা আছে কি না, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান একটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে বসে প্রেস কনফারেন্স করছেন। সেদিনই সরকারকে লন্ডনে ‘বিক্রি করে’ দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ।
গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী রমজানের আগে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠানোর কথা জানান।
পরদিন ৬ আগস্ট রোজা শুরুর আগে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা দিয়ে সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে, তখন জামায়াত এবং এনসিপি নেতাদের বক্তব্যে ভিন্ন অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংস্কার প্রস্তাব, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে শর্ত দিচ্ছে জামায়াত-এনসিপি। এতে শুধু সরকারের সঙ্গেই নয় বিএনপির সঙ্গেও দল দুটির মতপার্থক্য ও বিপরীত অবস্থান উঠে আসছে। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল দুটির সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য ও বিভক্তি বাড়ছে। জামায়াত-এনসিপি নেতাদের বক্তব্যে অভিযোগ উঠে আসছে যে, সংস্কার ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের বিষয় পাশ কাটিয়ে একটি সাজানো নির্বাচনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
আগে থেকেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত এবং এনসিপির মতপার্থক্য চলে আসছে। শুরু থেকেই বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দাবি করে আসছিল। বিএনপির দাবি ছিল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। তবে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর বিএনপি সেই অবস্থান থেকে সরে আসে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের জন্য সরকারের ঘোষণাকে বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে। তবে বিএনপির এই স্বাগত জানানোর বিষয়টিও ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত। আসন্ন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলেও জামায়াত নেতারা তাদের বক্তব্যে প্রকাশ্যে অভিযোগ করছেন। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশকে একটা ওয়ান-ইলেভেনের দিকে নিয়ে না যাওয়ার কথাও বলছেন।
জামায়াত এবং এনসিপি নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের শর্ত দিচ্ছে এবং তাদের শর্ত বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। এমনকি জাতীয় সংসদের চলমান নির্বাচনের পদ্ধতি বাতিল করে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতি চালু করার দাবিকেও জোরালোভাবে সামনে আনছে। এসব শর্ত বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনে যাওয়ার কথাও বলছে জামায়াত। আর এটা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দলটির দূরত্ব আরও বাড়বে।
এসব সার্বিক বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারের ওপর জামায়াতের অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে সরকারের সঙ্গে দলটির দূরত্ব। গত ১৩ আগস্ট জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের আইনগত ভিত্তি প্রদান এবং এর আলোকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াত। রাজধানীতে আয়োজিত ওই সমাবেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, আমরা ইলেকশন চাই, সিলেকশন চাই না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে যেতে চায়। কিন্তু তার আগে নির্বাচনের যে বিষয়গুলো প্রয়োজন, তা করতে হবে।
আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, নির্বাচনের তফসিলকে শুধু একটি দল স্বাগত জানিয়েছে, এটাই বোঝা যায় এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
সংস্কার অবশ্যই আগামী নির্বাচনের আগে হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি পরবর্তী সরকার দেবে। তাহলে এ সরকারের তো কোনো আইনগত ভিত্তি থাকে না।
জামায়াতের নায়েবে আমির আরও বলেন, আমরা বারবার বলে এসেছি, আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে। আর গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে অধিকাংশ জনগণের মতকে প্রাধান্য দেওয়া। আর দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতির পক্ষে। আপনাদের বিরোধিতার কোনো অধিকার নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। আর একটা ওয়ান ইলেভেনের দিকে নিয়ে যাবেন না।
অন্যদিকে শুরু থেকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার, মৌলিক সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে এনসিপি। আত্মপ্রকাশের দিনই তারা বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে বলে দাবি জানায়।
সম্প্রতি গণপরিষদ নির্বাচনের ওপর বেশ জোর দিয়েছে এনসিপি। দলটি বলছে, বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হলে তা গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে। এ ছাড়া জুলাই সনদের বিষয়েও ছাড় দিতে রাজি নয় এনসিপি। মৌলিক সংস্কার এবং বিচারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেই নির্বাচনের বিষয়ে মত দেবে দলটি।
ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। সম্প্রতি দলটির জাতীয় যুব সম্মেলনে তিনি বলেন, নির্বাচনের ডেট ঘোষণা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে; ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। তিনি বলেন, যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, আমার যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল সংস্কারের জন্য, তাহলে কবরে গিয়ে তার লাশটা ফেরত দিতে হবে এই সরকারকে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী আরও বলেন, আমার যে ভাইয়ের হাতটা চলে গিয়েছিল, যদি সংস্কার কাজ শেষ না করে নির্বাচন হয়, তাহলে এই সরকারকে আমার ভাইয়ের হাতটা ফিরিয়ে দিতে হবে। যে মায়ের বুক খালি হয়েছিল, ওই মায়ের বুকের সন্তানকে ফেরত দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে সরকারের কার্যক্রম ও অবস্থানের পক্ষেই সাধারণত অবস্থান নিয়েছে অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থীদের দ্বারা গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। তবে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার, মৌলিক সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে ক্রমশ দলটির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। দূরত্ব বেড়ে চলার বিষয়টি এনসিপি নেতাদের বক্তব্যেও প্রকাশ পাচ্ছে।
এফএইচ/এমজেএফ