Google Alert – সেনা
ইউক্রেন যুদ্ধের কূটনৈতিক ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে তুলেছে আলাস্কা আলোচনা। শুক্রবার বৈঠকের জের ধরে রোববার (স্থানীয় সময়) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও স্পষ্ট করে বললেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ থামাতে পারেন। তবে এজন্য ক্রিমিয়া ফেরত পাওয়ার আশা ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদানের স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে। যুদ্ধের সাড়ে তিন বছর যে কথাটি ট্রাম্পের মুখ থেকে বের হলো; ঠিক এই কথাটিই শুরু থেকে বলে আসছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দিনশেষে সেই পথেই হাঁটল বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রও। অর্থাৎ ইউক্রেনের হালহকিকত বা ভবিষ্যৎ যেটাই বলি না কেন-পুতিনই শেষ কথা!
সোমবার হোয়াইট হাউজের ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ইইউ নেতাদের ‘ঐতিহাসিক’ বৈঠকেও সে সুরই শোনা যায় ট্রাম্পের কণ্ঠে। বৈঠক উপলক্ষ্যে রোববার রাতেই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান জেলেনস্কি। স্থানীয় সময় সোমবার দুপুর ১২টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা) হোয়াইট হাউজের দক্ষিণ পোর্টিকোতে উপস্থিত হন ইউরোপীয় নেতারা। এর এক ঘণ্টা পরেই দুপুর ১টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা) বৈঠকে বসেন ট্রাম্প-জেলেনস্কি। তবে জেলেনস্কিকে অভ্যর্থনায় উল্লেখযোগ্য কোনো আড়ম্বর ছিল না। যেমনটি ছিল আলাস্কায় পুতিনের লাল গালিচা অভ্যর্থনায়। আবার সময়ের বেলায়ও বাধাধরা-৪৫ মিনিট মাত্র। আলাস্কায় ছিল ‘অনির্ধারিত’।
গত ফেব্রুয়ারিতে ওভাল অফিসে নিজের সাধারণ পোশাকের (ফুল হাতা সামরিক গেঞ্জি) জন্য ট্রাম্পের তোপের মুখে পড়েছিলেন জেলেনস্কি। এবার আর সে ভুল করেননি। কালো স্যুট ও কালো শার্ট পরেই এবার হোয়াইট হাউজে এসেছেন। ট্রাম্প তার পোশাকের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমরা ইউক্রেনীয়দের ভালোবাসি। রুশদেরও সমান ভালোবাসে বলে জানান’। এর আগেই অবশ্য সংবাদমাধ্যম পলিটিকোকে তার পোশাকের ডিজাইনার গাসানোভা বলেন, এবার প্রেসিডেন্ট স্যুট পরবেন। তবে স্যুটটির নকশায় সামরিক ছোঁয়া থাকবে। গাসানোভা বলেন, ‘তিনি এমন একটি অবস্থায় রয়েছেন, যেখানে প্রতিটি খুঁটিনাটি গুরুত্বপূর্ণ। তার চেহারা, মেজাজ, আবেগ। তাই তিনি এমন এক ভাবমূর্তি বেছে নেন, যা তার ভূমিকা এবং বর্তমান সময়ের সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই।’ বৈঠকের শুরুতে, জেলেনস্কি তার স্ত্রী ওলেনা জেলেনস্কির কাছ থেকে ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পের কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি হাতে তুলে দেন, যেখানে তিনি রাশিয়ায় আটক ইউক্রেনীয় শিশুদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার জন্য মার্কিন ফার্স্ট লেডিকে ধন্যবাদ জানান।
জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের সময় ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে ছিলেন পাঁচজন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফ সুসি ওয়াইলস, বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং বিশেষ দূত কিথ কেলগ। জেলেনস্কির সঙ্গে ছিলেন দুজন। চিফ অব স্টাফ আন্দ্রি ইয়েরমাক, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং বর্তমানে ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের প্রধান রুস্তেম উমেরভ।
বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘‘আজকের বৈঠক শেষ নয়। এটা কোনো ‘ডিল বা নো ডিল’ নয়। মানুষ মারা যাচ্ছে, আমরা সেটা থামাতে চাই। আমার বিশ্বাস, পুতিনও যুদ্ধ শেষ করতে চান।” তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি ছয়টি যুদ্ধ শেষ করেছি। ভেবেছিলাম এই যুদ্ধ হয়তো সহজ হবে, কিন্তু এটা সবচেয়ে কঠিন। তবে আমি আত্মবিশ্বাসী, আমরা সমাধান খুঁজে পাব।’ যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে এক লাফে ৩৬০ ডিগ্রি উলটে গেছেন ট্রাম্প। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন যুদ্ধবিরতি না হলে কি গুরুতর পরিণতি হবে? উত্তরে ট্রাম্প বলেন , আমি মনে করি না যে যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন আছে। এটি থাকা ভালো হতে পারে। তিনি আরও বলেন, এটি শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে। তিনি আরও যোগ করেন যে, ‘কৌশলগত কারণে একটি দেশ যুদ্ধবিরতি নাও চাইতে পারে। অথচ শুক্রবার আলাস্কা বৈঠকে যাওয়ার সময় এয়ার ফোর্স ওয়ানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতি না মানলে ভয়াবহ পরিণতি হবে রাশিয়ার।
ইউক্রেনের নিরাপত্তার প্রশ্নে বলেন, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তায় যুক্ত থাকবে যক্তরাষ্ট্র। অরেকটু গুছিয়ে বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তার প্রথম সারিতে থাকবে ইউরোপ। আমরা শেষের সারিতে-জেড ক্লাস। এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কি গ্যারান্টি চান’ প্রশ্নের উত্তরে জেলেনস্কি বলেন-সবকিছু। ট্রেনিং, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম এবং গোয়েন্দা তথ্য। জেলেনস্কি যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, ‘হত্যাযজ্ঞ থামাতে ও যুদ্ধ বন্ধ করতে আপনার প্রচেষ্টা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দেখছি।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি আশা করি, কিছু একটা ফল আসবে।’ তিনি জানান, ইউরোপের সাতজন নেতাও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন। ইইউ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও ফোন করবেন বলে জানান ট্রাম্প।
ওভাল অফিস বৈঠকের এক ঘণ্টা পরে ২টা ৩০ (বাংলাদেশ সময় রাত ১টা ৩০) মিনিটের মধ্যে অন্যান্য ইউরোপীয় নেতাদের রাষ্ট্রের ডাইনিং রুমে অভ্যর্থনা জানান ট্রাম্প। এর ১৫ মিনিট পর ক্রস হলে ট্রাম্প ও ইউরোপীয় নেতারা একসঙ্গে ফটো তোলেন। এরপর ৩টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা) ট্রাম্প ও ইউরোপীয় নেতারা হোয়াইট হাউজের ইস্ট রুমে উচ্চস্তরের বৈঠকে অংশ নেন। এই বৈঠকে ছিলেন জেলেনস্কিও। ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মার্জ, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লায়েনও উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।
এর আগে আলাস্কা বৈঠকে (শুক্রবার) ওই বৈঠকে ক্রিমিয়ার মতো কিয়েভের আরও দুই বৃহৎ অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবও দেন পুতিন। বিনিময়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। জেলেনস্কি এ প্রস্তাব অস্বীকার করলেও সেই প্রস্তাবেও সম্মত হন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের ভূমি ভাগাভাগি ও নিরাপত্তাজনিত নিশ্চয়তা নিয়ে পুতিনের প্রস্তাবে ‘বড় ঐকমত্য’ হয়েছে। স্থানীয় সময় সোমবার হোয়াইট হাউজে জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের আগেই ট্রাম্পের এই বার্তা যেন এক অঘোষিত চাপ। যা ইঙ্গিত করে-যুদ্ধের ময়দানে অসংখ্য সেনার জীবন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহর, লাখ লাখ মানুষের আশ্রয়হীনতা, এসব জটিল হিসাবের মধ্যে শেষ সিদ্ধান্তটা কেবল পুতিনেরই। সিএনএন, বিবিসি।
রোববার নিজের মালিকানাধীন ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করতে পারেন অথবা লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘ওবামার আমলে হারানো ক্রিমিয়া আর ফেরত পাওয়া যাবে না। আর ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়াও সম্ভব নয়। কিছু জিনিস কখনোই বদলায় না!’ শুক্রবার আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর রোববার এমন মন্তব্য করেন ট্রাম্প।