অনুশোচনা নেই কেন?

Google Alert – সশস্ত্র

আমরা কম বেশি ভুল করি, করি না? কিন্তু আমাদের অনুশোচনা হয় না কেন? বাংলাদেশ এবং বাঙালিসহ আরও কিছু মানুষের বসবাস এই দেশটিতে। যেভাবেই হোক দেশটা দীর্ঘ ৯ মাসেই সেই ৭১-এ স্বাধীন হয়ে গেলো। শেখ মুজিব দেশে ফিরলেন, নিজ দায়িত্বে প্রেসিডেন্ট হলেন যদিও চারদিকের চামচারা নানা ধরনের রাজনৈতিক সুবিধা নিতে নির্লজ্জের মতো কেউ কিছু বলেনি।

সম্ভবত বিনা শপথেই নিজ দায়িত্বে প্রেসিডেন্ট হলেন এবং পরে আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে নিজে প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারপর কোন ফাঁকে জাতির পিতায় ভূষিত হলেন এবং বঙ্গবন্ধু হলেন। শেষ পর্যায়ে একদলীয় শাসন চালু করে রাষ্ট্রকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পথে নিয়ে গেলেন।

এরপর এলো জিয়াউর রহমানের উত্থান। মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হিসেবে ক্ষমতায় এসে তিনি রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়তে চাইলেন। তার উদ্যোগে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়, বহুদলীয় রাজনীতি ফিরে আসে। কিন্তু ক্ষমতার খেলায় তার শাসনও স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বিতর্কিত রয়ে যায়।

তারপর এলো হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দীর্ঘদিন শাসন করেন। তার সময়ে প্রশাসনিক অবকাঠামোর কিছু সংস্কার হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতি ঘটে। দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা সেই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এরশাদের শাসন আমাদের শেখায়—সামরিক শাসন কখনোই জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র গড়তে পারে না।

পরে এলো খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পালাবদলের দীর্ঘ ইতিহাস। দুই দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, দলীয় স্বার্থসিদ্ধি ও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে দেশ বারবার আঘাত পেয়েছে। এক সময় গণতন্ত্র কেবল ভোটের সংখ্যায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার ও সমতার প্রশ্ন পিছিয়ে গেছে।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত? ইতিহাসে আমরা দেখেছি সেনাবাহিনী বারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেছে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাদের মূল দায়িত্ব হলো জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য ভাঙা নয়। ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হলো—সশস্ত্র বাহিনীকে নিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে রাখতে হবে, যেন তারা গণতন্ত্রকে রক্ষা করে, হুমকি না হয়।

এরপর এলো ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার। তাদের দুটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো—প্রথমত, দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা থাকলেও সেটি ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, লুটপাট সত্ত্বেও দেশ দেউলিয়া হয়ে যায়নি। তবে প্রশাসনিক সংস্কার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তরে তারা কার্যকর হতে পারেনি। এখন দেখার পালা তারা একটি সত্যিকারের সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হন কিনা।

সবশেষে নতুন প্রজন্মের কথা আসছে। ২০২৪ সালে তারা দেশের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—তারা কি সেই অধিকার ধরে রাখতে পারবে? তাদের নৈতিক মূল্যবোধ কি অতীতের নেতাদের থেকে ভিন্ন কিছু হবে? যদি না হয়, তবে আমরা আবারও একই অনুশোচনার চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকব।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে নেতৃত্ব সংকট, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পুনরাবৃত্তি আমাদের জাতীয় জীবনে আজ গভীর অনুশোচনার জন্ম দিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সময়কাল পর্যন্ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি—রাষ্ট্রের কাঠামো সংস্কারের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার চর্চা। যার ফলে প্রশাসন দুর্বল হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীকে কখনো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, আবার কখনো তারা পর্দার আড়ালে নীতিনির্ধারণী প্রভাব বিস্তার করেছে।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে। প্রশাসন রাজনৈতিক আনুগত্যের বন্দি হয়ে পড়েছে, যেখানে দক্ষতা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা অবহেলিত। একইভাবে, সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের প্রভাব কোথায় সীমিত থাকবে—সেই প্রশ্নের কোনো সুস্পষ্ট উত্তর আমরা পাইনি। ফলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বারবার জাতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে।

অতএব, এখন দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন সহজ নয়। কারণ বাস্তবতা হলো—আজকের তরুণদের একটি বড় অংশ বেকার। তাদের হাতে নেই পর্যাপ্ত ক্ষমতা, নেই দক্ষতা, নেই কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। ফলে তারা সারাদিন রাজনৈতিক নেতাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, কখনো ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি ও লুটপাটে অংশ নেয়, আবার কখনো রাজনৈতিক হানাহানির বলি হয়। তাদের বেকারত্ব দূরীকরণে কোনো কার্যকর পরিকল্পনা নেই, কারণ দুর্নীতিবাজ সরকার টিকে থাকার স্বার্থে এই তরুণ সমাজকে ব্যবহার করছে নিজেদের ক্ষমতার খেলায়—ফলে দেশের বারোটা বাজছে।

আমি ভেবেছিলাম, অন্তবর্তী সরকারের নেতৃত্বে ড. ইউনূস অন্তত একটি জাতীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনা তৈরি করবেন, একটি সঠিক রোডম্যাপ দেখাবেন—যেন তরুণ প্রজন্ম দক্ষতায়, সততায় এবং সৃজনশীলতায় জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তিনি সেই কাজটিও করতে পারেননি।

বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের এখন একটাই শিক্ষা দেয়—অনুশোচনা ছাড়া আমাদের পরিবর্তন হবে না। শেখ মুজিব থেকে জিয়া, এরশাদ থেকে খালেদা-হাসিনা পর্যন্ত প্রতিটি যুগে ভুল ছিল, অন্যায় ছিল। কিন্তু কোথাও প্রকৃত অনুশোচনা দেখা যায়নি। সেই কারণেই একই ভুল বারবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

আমাদের সামনে একমাত্র করণীয় হলো—একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, যেখানে শিক্ষাকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করা হবে, তরুণদের জন্য প্রযুক্তি ও শিল্পভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করা হবে, এবং নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হবে।

নতুন প্রজন্ম যদি সেই সঠিক দিকনির্দেশনা পায়, তবে তারা শুধু নিজেদের নয়, জাতির ভবিষ্যৎও আলোকিত করতে পারবে। অন্যথায়, আমরা বারবার একই প্রশ্নেই ফিরে যাব—এতো কিছুর পরেও আমরা আমাদের অনুশোচনা করি না কেন?

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে, অনুশোচনার সংস্কৃতি গড়ে তুলে, আমরা যদি একটি নৈতিক ও সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে পারি, তবে জাতির ভবিষ্যৎ আলোকিত হবে। কিন্তু যদি তা না হয়, তবে আমরা শুধু প্রশ্ন করেই যাব—এতো কিছুর পরেও দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বারবার দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, কিন্তু কই—তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন তো হয়নি, হচ্ছে না! তারপরও আমাদের কোনো অনুশোচনা নেই, কিন্তু কেন?

—রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]

এমআরএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি,
স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা
পাঠানোর ঠিকানা –
[email protected]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *