ভেলায় চড়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা

Bangla Tribune

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহিংসতার কারণে আবারও বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। রাখাইনের বুথিডং থেকে কলাগাছের ভেলায় চড়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছেন তারা। দালালের মাধ্যমে টেকনাফে অনুপ্রবেশ করছেন বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ইনচার্জ ও রোহিঙ্গারা। সবশেষ সোমবার (১৮ আগস্ট) ২৫-৩০ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছেন। এরপর থেকে সীমান্তে কড়াকড়ি শুরু হওয়ায় মঙ্গলবার অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া যায়নি।

টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২৬ ও ২৭-এর ইনচার্জ খানজাদা শাহরিয়ার বিন মান্নান মঙ্গলবার বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিছু রোহিঙ্গা ভেলায় চড়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জেনেছি। ২৫-৩০ জনের মতো হবে। তবে তারা উখিয়ার ক্যাম্পের দিকে চলে গেছে। ক্যাম্পের মাঝিদের (প্রতিনিধি) সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সীমান্তে অনেক রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছে। তবে তারা ঢুকতে পারেনি।’

সোমবার ভেলায় চড়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনায় স্থানীয় দুই দালালকে আটক করেছে বিজিবি। মঙ্গলবার তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। তারা হলেন- টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়ার বাসিন্দা শামসুল আলম (৪৫) ও একই এলাকার মোহাম্মদ আলমগীর ওরফে জাবের (৩১)।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত তিন-চার দিনে শতাধিক রোহিঙ্গা টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। অনুপ্রবেশের জন্য মংডু সীমান্তে জড়ো হয়েছেন আরও দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। যারা রাখাইনে আরাকান আর্মিকে টাকা দিয়ে অনুপ্রবেশর জন্য সীমান্তে জড়ো হয়েছেন। সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ার অপেক্ষায় আছেন। বিশেষ করে নাফ নদ সীমান্তে স্মার্ট ডিজিটাল সার্ভেইল্যান্স ফাঁকি দিতে দালালরা নৌকার পরিবর্তে কলাগাছের ভেলা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের পারাপার করছে। নৌকায় পারাপারের দৃশ্য স্মার্ট ডিজিটাল সার্ভেইল্যান্সে ধরা পরলেও ভেলায় সেটি ধরা মুশকিল। সে সুযোগ নিচ্ছে দালালরা।

তবে নাফ নদ ও সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।

এ বিষয়ে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনায় যেসব দালাল জড়িত রয়েছে, তাদের আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।’  

মঙ্গলবার বিকালে টেকনাফের জাদিমুড়াসহ নাফ নদের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে বিজিবির সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির এক সদস্য বলেন, ‘সোমবার বিকালে জাদিমুড়া থেকে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এরপর থেকে সীমান্তে আরও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আসলে এত বড় সীমান্ত বিজিবির একার পক্ষে পাহারা দেওয়া খুব কঠিন। ফাঁকি দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।’

জাদিমুড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নাগরিক মোহাম্মদ কাওছার উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পের ওপারে লালদিয়া এবং পেরাংপু। সেখানে বেশ কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপক্ষোয় জড়ো হয়েছে। হঠাৎ করে গত কয়েকদিন ধরে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের জড়ো হতে দেখা যাচ্ছে। রাখাইনে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংহিংসতার কারণে তারা আসছে। গতকাল এই পয়েন্ট দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। পরে তারা গাড়িতে করে উখিয়ার দিকে চলে গেছে।’

জাদিমুড়া ক্যাম্পের দোকানি মো. কাসেম বলেন, ‘রাখাইনের বুথিডংয়ে সহিংসতা চলছে। যার কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা এপারে পালিয়ে আসছে। সীমান্তের ওপারে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে ঢুকতে পারছে না তারা। তবে রাতের আঁধারে অনেকে ঢুকছে।’

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ফলে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার জল-স্থলপথে বিজিবির টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আশিকুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘সীমান্তে কড়াকড়ির মধ্যে ভেলা নিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে তাদের প্রতিরোধ করা কঠিন। কারণ অনেক সময় তারা আমাদের জেলেদের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে শনাক্ত করাও মুশকিল হয়ে পড়ে। সে সুযোগে অনেকে ঢুকছে। তবে বিজিবি সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে আছে।’  

টেকনাফের ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি ব্লকের মাঝি মো. নুর। তিনি ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসলেও তার পরিবারের নয় জন সদস্য এখনও রাখাইনের মাংগালা এলাকায় রয়েছেন। সেখানে তারা আরাকান আর্মির নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন জানিয়ে নুর বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যরা মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করে। বাংলাদেশে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করে। কিন্তু তাদের আসতে হলে বিপুল টাকা প্রয়োজন। আরাকান আর্মিকে টাকা না দিলে সীমান্ত অতিক্রম করা যায় না। বর্তমানে ওই সশস্ত্র সংগঠন প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবারের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে। শুধু তাই নয়, তাদের ঘরে থাকা তেল-মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করছে আরাকান আর্মি। এ পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে রোহিঙ্গারা নতুন করে প্রাণ বাঁচাতে এপারে পালিয়ে আসছে।’

আটক দুই দালালকে কক্সবাজার কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা পারাপারের ঘটনায় বিজিবি স্থানীয় দুই দালালকে আটক করে থানায় হস্তান্তর করেছিল। পরে তাদের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।’  

প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। কিন্তু গত প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত ও সহিংসতার কারণে গত ১৮ মাসে নতুন করে দেড় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোয় এসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছেন ১ লাখ ২১ হাজার। আর অন্যরা নিবন্ধন ছাড়াই আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাস করছেন। নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *