শঙ্কা কমেছে, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন

Google Alert – সেনাবাহিনী

ঢাকা: নানা সংশয়, মতপার্থক্য ও বিভেদের মাঝেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর থেকে সরকারের সর্বস্তর ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।


মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এ প্রসঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা মাথার মধ্যে এটাই রাখছি- ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন, আমরা ফেব্রুয়ারিতেই চলে যাব। এখন রাজনৈতিক দল তো বিভিন্ন উদ্দেশে বিভিন্ন কথা বলে এবং ওইটা তো একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আপনারা তো এটা সবসময় দেখেছেনই।


একই দিন সকালে ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, দেশ এখন জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।


এর আগে ১৫ আগস্ট মাগুরায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম স্পষ্ট করে বলেন, “নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে এবং রোজা শুরু হওয়ার আগেই হবে। কেউ বাধা দিয়ে নির্বাচন বিলম্ব করাতে পারবে না। ” নির্বাচন কমিশনও একই সময়সূচি সামনে রেখে প্রস্তুতি চালাচ্ছে।


তবে নির্বাচন পদ্ধতি ও সময় ঘিরে ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বিভিন্ন শর্ত দিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। সংস্কার প্রস্তাবের জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং নতুন ভোটপদ্ধতি চালুর দাবিতে তারা নির্বাচনের আগে চাপ সৃষ্টির কৌশল নিচ্ছে।


মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে জাতীয় যুবশক্তি আয়োজিত যুব সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ডেট ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে সংস্কার ও নতুন সংবিধানের জন্য যারা শহীদ হয়েছিল, তাদের জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে সরকারকে। “


রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের অবস্থান বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশল। কারণ বিএনপি শুরু থেকেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও লন্ডন বৈঠকের মাধ্যমে তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে রাজি হয়েছে। সেখানে জামায়াত ও এনসিপি নিজেদের দাবিদাওয়া উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে করছে। বিশেষ করে, তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক ও যৌথ বিবৃতিকে ‘একটি দলের প্রতি সরকারের পক্ষপাত’ হিসেবে দেখছে তারা।


অন্যদিকে, বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন এখন ব্যাপক বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে- এমন প্রত্যাশাই ভোটের রাজনীতিতে ঘনীভূত হচ্ছে। ফলে বিএনপির কোনো প্রার্থী বা নেতাই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না। কৌশলে ছাড় দিয়ে হলেও আগামী নির্বাচনে সব দলেরই অংশগ্রহণ তারা প্রত্যাশা করছে বলে জানা গেছে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে।


এদিকে ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত বা এনসিপি, কেউই তেমন সুবিধাজনক অবস্থান বা সম্ভাবনা তৈরি করতে না পারায় কোণঠাসা অবস্থায় পড়ছে। সাংগঠনিক শক্তির বাইরে সাধারণ মানুষের বিস্তৃত বা ব্যাপক সমর্থন নেই জামায়াতের পক্ষে। এনসিপির সমাবেশগুলো লক্ষ্য করলেও একই চিত্র দেখা যায়। জনমানুষের খুব কাছে এখনো তারা পৌঁছাতে পারেনি। ফলে নিজেদের ওপর এসে পড়া চাপ থেকে অন্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই জামায়াত-এনসিপি, দুটি দলই নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।


এরই অংশ হিসেবে নির্বাচনের আগে ‘জুলাই সনদ’কে আইনগত ভিত্তি দিয়ে বাস্তবায়ন করার দাবি তুলেছে জামায়াত-এনসিপি। এর সঙ্গে ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতি উচ্চকক্ষ–নিম্নকক্ষ উভয় সংসদেই চালুর প্রস্তাব জোরালো করেছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কারের সনদ আগে বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা এতে বাধা তৈরি করছে, তারাই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। “


বিএনপি শুরু থেকেই এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে এসেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেন, “যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তারা নতুন নতুন তত্ত্ব আনছে। পিআর নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করা হচ্ছে। সংস্কার কার্যক্রমে বিএনপিকে বিরোধী পক্ষ বানানোর চেষ্টা চলছে। সংবিধান সংশোধনের একমাত্র অধিকার তাদেরই, যারা জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসবে, অন্য কারও অধিকার নেই। “


এদিকে শনিবার (১৬আগস্ট) সন্ধ্যায় জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে বিএনপিসহ দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা-বিশ্লেষণ করছে। সনদে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যের কথা বলা হয়েছে। আর ১৫টি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে দলগুলো। এর মধ্যে ১০টি প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে বিএনপি।


তবে বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জুলাই সনদের নোট অব ডিসেন্ট চূড়ান্ত খসড়ার মতামতে কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়ে আরো উদারতা দেখাবে তারা। বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষের পিআর পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতিসহ দু-তিনটি বিষয়ে ছাড় দেওয়া হতে পারে। এমন সুর শোনা গেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের কণ্ঠেও। জুলাই সনদে মতপার্থক্যে থাকা বিষয়গুলো নিয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “এগুলো নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা ব্যবস্থা বের করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। “


এছাড়া ১৯ আগস্ট গুলশানে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিও প্রায় শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। যারা মাঠে নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন, তারা কৌশলগত কারণে বলছেন। এ বিষয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই।  


কিছু বিষয়ে বিএনপি ছাড় দিলে নির্বাচন নিয়ে কারোই আপত্তি থাকার কথা না বলে মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাকেই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব বলে মনে করছেন।  


এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, “নির্বাচনের সময় ঘোষণার পরও নানা দল নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে, তা দেবেই। এগুলো বিএনপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল হতে পারে, আবার নির্বাচনে আসনের ব্যাপারে দরকষাকষির বিষয়ও থাকতে পারে। সরকারের এখন লক্ষ্য থাকা উচিত কীভাবে ফেব্রুয়ারিতে একটা সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যায়। “


এদিকে নির্বাচন নিয়ে এনসিপির নানা ধরনের বক্তব্যকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আমলে না নেওয়ার বিষয়েই মত দিচ্ছেন। এমনকি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না, এনসিপির নেতার দেওয়া এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (১৭ আগস্ট) দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, এনসিপি কী বললো, তাতে কিছু যায় আসে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে বিভিন্ন দলের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ ও রাজনীতি আছে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে।


এরইমধ্যে এনসিপির ইমেজ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের বিভাজন ঘটানো বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে দলের অনেক নেতাই জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। অভ্যুত্থানের বছর ঘুরতেই এনসিপিকে নিয়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাও ফিকে হতে শুরু করেছে। দলটির কেউ কেউ জড়িয়েছেন নানা বিতর্কিত ও অনৈতিক কাজেও। ফলে নির্বাচন নিয়ে তাদের বক্তব্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।


সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মঞ্চে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ, কৌশল ও পাল্টা কৌশল। সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সেনাবাহিনী যে দৃঢ়ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাতে নির্বাচন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিএনপি ইতোমধ্যে অংশগ্রহণে সম্মত হওয়ায় নির্বাচনের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা আরও জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপির আপত্তি বা দাবি আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, জনসমর্থন সেভাবে অর্জন করতে পারছে না তারা। ফলে ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে—এটাই এখন দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার অগ্রযাত্রায় এটি হবে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।


এসবিডব্লিউ/এজে

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *