রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনার জটিল কেন্দ্রে ‘ডনবাস’

Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও শান্তির আলো এখনো অধরা। বরং ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে কূটনীতির সমীকরণ। সম্প্রতি আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন সম্মেলনে আবারও আলোচনার টেবিলে উঠে এসেছে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডনবাস। পুরো অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণকে যুদ্ধবিরতির প্রধান শর্ত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রশ্ন উঠেছে—কেন এই ডনবাসই শান্তি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে?

ডনবাস: যুদ্ধের জটিল কেন্দ্র

দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে গঠিত ডনবাস—যেটি একসময় ইউক্রেনের শিল্পশক্তির প্রাণকেন্দ্র ছিল। আজ সেটিই পরিণত হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের প্রতীকে। লুহানস্ক প্রায় পুরোপুরি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, তবে দোনেৎস্কের ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো এখনো ধরে রেখেছে ইউক্রেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এই নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। তাই পুতিন জোর দিয়েই দাবি করছেন, ইউক্রেনের শিল্পাঞ্চল দোনেৎস্কসহ পুরো ডনবাস রাশিয়ার হাতে আসতেই হবে।

ইউক্রেনের অনড় অবস্থান

কিন্তু ভূখণ্ড ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না—এই বার্তাই দিয়ে আসছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির জরিপও বলছে একই কথা—দেশটির ৭৫ শতাংশ নাগরিক কোনো ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে রাজি নন। এ কারণে শান্তি আলোচনার সব প্রচেষ্টাই এসে ঠেকছে এক অনিশ্চিত অচলাবস্থায়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: দীর্ঘদিনের লক্ষ্যবস্তু

ডনবাসকে দখলে আনার চেষ্টা নতুন নয়। ২০১৪ সালেই ক্রেমলিনপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই এ অঞ্চলে অস্থিরতা শুরু হয়। একই সময়ে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। রুশ সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তখন দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে স্বঘোষিত ‘পিপলস রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

২০২২ সালে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর রাশিয়া ডনবাসের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নেয়। বর্তমানে ৮৮ শতাংশ ভূখণ্ডই মস্কোর হাতে, যদিও দোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো রক্ষায় কিয়েভকে দিতে হয়েছে ভয়াবহ মানবিক মাশুল।

কেন ডনবাস এত গুরুত্বপূর্ণ?

ডনবাস—আসলে দোনেৎস বেসিনের সংক্ষিপ্ত রূপ। কয়লা ও ইস্পাত শিল্পে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল সোভিয়েত আমলে ছিল শিল্পায়নের মূল ভিত্তি। এখানকার বড় অংশের মানুষ রুশভাষী। সোভিয়েত ভাঙার পরও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিল তারা।

সেই ঐতিহাসিক ও ভাষাগত সংযোগকে ভিত্তি করেই পুতিন ডনবাসকে নিজের দাবির কেন্দ্র করেছেন। যদিও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ডনবাসে রুশভাষীদের ‘গণহত্যা’ হয়েছে বলে পুতিনের যে অভিযোগ, তা নিছক যুদ্ধ শুরুর অজুহাত মাত্র।

রুশ জনমত বনাম রাষ্ট্রীয় প্রচারণা

ডনবাস নিয়ে রাশিয়ার ভেতরে তেমন আবেগ কাজ করে না, যেমনটা দেখা যায় ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে। আগ্রাসনের আগ মুহূর্তে জরিপে দেখা গিয়েছিল—মাত্র এক-চতুর্থাংশ রুশ নাগরিক ডনবাসকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করতে চান। তবে দীর্ঘ যুদ্ধ আর রাষ্ট্রীয় প্রচারণা ধীরে ধীরে এই অবস্থান বদলে দিয়েছে। এখন বেশিরভাগ রুশ নাগরিক পুতিনের ডনবাসকে ‘সুরক্ষা’ দেওয়ার যুক্তি সমর্থন করছেন।

কেবল ডনবাস পেলেই কি শান্তি?

আলাস্কার বৈঠকে পুতিন ইঙ্গিত দিয়েছেন, ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ পেলে দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ায় যুদ্ধ থামাতে রাজি তিনি। তবে এখানেই শেষ নয়—শুরু থেকেই তিনি চারটি অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে দাবি করে আসছেন। পাশাপাশি খারকিভ, সুমি ও চেরনিহিভে ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠার কথাও তুলেছেন।

ক্রেমলিনের এক সাবেক কর্মকর্তা বলছেন—পুতিন আসলে সুযোগসন্ধানী। প্রথমে তার নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা ছিল না। কিন্তু একবার সাফল্যের স্বাদ পেলেই তার দাবি বেড়ে যায়।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার অর্থনীতি ও সামরিক সক্ষমতা ডনবাসের বাইরে খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার মতো নয়। তবুও যুদ্ধ চলতে পারে বছরের পর বছর, কারণ পুতিনের জন্য এটি কেবল ভূখণ্ড নয়—একটি মর্যাদার প্রশ্ন।

অন্যদিকে ইউক্রেনও দোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো ছাড়তে নারাজ। তাদের মতে, ডনবাস ছেড়ে দেওয়া মানে রাশিয়াকে ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের জন্য লঞ্চপ্যাড উপহার দেওয়া।

আজকের ডনবাস শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, বরং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতীক হয়ে উঠেছে। শান্তির আলোচনার টেবিলে যতবার বসা হচ্ছে, বারবার ঘুরেফিরে আসছে সেই একই প্রশ্ন—ডনবাস কার হাতে থাকবে?

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *