The Daily Ittefaq
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। আওয়ামী লীগের সমাবেশে ঐ নারকীয় হামলায় ২৪ জন নিহত হন, আহত হন কয়েক শতাধিক মানুষ। রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যে তদন্তের কারণেই বিচার প্রক্রিয়াকে বিকৃত করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, তদন্ত শুরু থেকেই রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা হয়েছে, আসামি তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে, ফলে বিচারকাজ বিকৃত হয়েছে। হাইকোর্টের ভাষায়, ‘এমন একটি ভয়াবহ ঘটনায় সত্য উদঘাটন না হওয়া এবং দোষীদের আইনের আওতায় না আনা রাষ্ট্রের জন্য এক বড় ব্যর্থতা।’
গত বছরের পহেলা ডিসেম্বর নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ঐ রায়ে নিম্ন আদালতের সাজার রায় বাতিল করে সব আসামিকে খালাস দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছে। এ নিয়ে চার দিন আপিল বিভাগে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজো সরকারের আপিল শুনানির কার্যতালিকায় রয়েছে।
দুই দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এই ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, আমরা অনুভব করি, ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত। একই সঙ্গে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আদেশের অনুলিপি ঐ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ অভিমত দেন। অভিমতে হাইকোর্ট বলে, এই ঘটনায় আইভি রহমানসহ অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। স্বাধীন ও যথাযথভাবে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা প্রয়োজন, যা আজ পর্যন্ত এই মামলায় সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
প্রথম চার্জশিটের ওপর নির্ভর না করে মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে নতুন চার্জশিট দাখিল করা হয়। হাইকোর্ট এ চার্জশিটকে অবৈধ আখ্যা দেয়। কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ হাজির করা যায়নি যে অভিযুক্তরা হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল। আদালত বলেছে, ‘সাক্ষ্য ও প্রমাণ দুর্বল, অসংগতিপূর্ণ এবং সন্দেহজনক।’
হাইকোর্ট বলেছে, মামলাটির তদন্ত সঠিকভাবে হয়নি। শুরু থেকেই তদন্তকে রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত করা হয়েছে। একপর্যায়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে এবং মামলার নথি পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে যেই সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল, তা আইনসংগত ছিল না। আদালতের মতে, এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ হাজির করা যায়নি। অনেক সাক্ষ্যের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। মূল চার্জশিট বাদ দিয়ে নতুন চার্জশিটে আসামির তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। এই ত্রুটিগুলোই মামলার রায়কে দুর্বল করেছে এবং শেষ পর্যন্ত আসামিরা খালাস পেয়েছে।
হাইকোর্টের ভাষায়, ‘এমন একটি ভয়াবহ ঘটনায় সত্য উদঘাটন না হওয়া এবং দোষীদের আইনের আওতায় না আনা রাষ্ট্রের জন্য এক বড় ব্যর্থতা।’
হাইকোর্টের এই মন্তব্য নিছক একটি পর্যবেক্ষণ নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের নগ্ন স্বীকারোক্তি। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার না হওয়া নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের একটি বড় ব্যর্থতা। হাইকোর্টের রায় কেবল একটি মামলার রায় নয়; এটি আমাদের বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর কঠিন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা
এই মামলার তদন্ত করেন পুলিশের একজন বিতর্কিত তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দ। তিনি ছিলেন তখন অবসরকালীন ছুটিতে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। এর আগে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল হয়েছিল। ঐ চার্জশিটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অভিযুক্ত ছিলেন না। আব্দুল কাহহার আকন্দ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হওয়ার পর অন্য মামলায় কারাগারে আটক মুফতি আব্দুল হান্নানকে দিয়ে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পদক্ষেপ নেন। আইনের দৃষ্টিতে দ্বিতীয় জবানবন্দি গ্রহণযোগ্য ছিল না। প্রথম জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান এই ঘটনার সঙ্গে তারেক রহমানকে জড়িয়ে কোনো সাক্ষ্য দেননি। তাকে ৪১০ দিন টিএফআই সেলে আটক রেখে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জবানবন্দি আদায় করা হয়েছিল বলে আইনজীবীরা অভিযোগ করেন। এছাড়া সম্পূরুক চার্জশিট যে প্রক্রিয়ায় দাখিল করা হয়েছিল তাও ফৌজদারি আইনে অনুমোদন করে না।
প্রসঙ্গত, প্রথম চার্জশিটের ভিত্তিতে ৬১ জনের সাক্ষ্য আদালতে গৃহীত হয়েছিল। মামলার বিচার থামিয়ে পুনঃতদন্তের আদেশও অবৈধ ছিল আইনের দৃষ্টিতে। এভাবে নানান প্রক্রিয়ায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারকে নষ্ট করা হয়েছিল।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, তদন্তের স্বচ্ছতা নষ্ট হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আর এই ব্যর্থতা কেবল ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর প্রতি অবিচার নয়, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য কলঙ্ক। ২১ আগস্ট মামলা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক ট্র্যাজেডি, কারণ এটি প্রমাণ করেছে, যখন তদন্ত রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত হয়, তখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয় না।