বিভিন্ন দলের নেতা ও ডিসি-এসপি মিলেমিশে পাথর লুট

The Daily Ittefaq

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনীতির মাঠ অনেকটাই খালি। আওয়ামী লীগ নেতারাও আত্মগোপনে। বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতির মাঠে বিরোধী চরিত্রে দেখা গেলেও সিলেটে পাথরলুটে তারা এক। পাথর লুটকারী হিসেবে একযোগে উঠে এসেছে বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগ ও এনসিপির  অনেক নেতার নামও।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সিলেটের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং বিজিবির অনেক সদস্যও এর সঙ্গে জড়িত আছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ঐ প্রতিবেদনে। নিয়মিত টাকা পেতেন পুলিশের এসআই ও কনস্টেবলরাও। সবমিলিয়ে প্রশাসনের পকেটে গেছে প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা সব সময় পাথর উত্তোলনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। বিগত পাঁচ বছরে তারা নানাভাবে পাথর কোয়ারি ইজারা আবার চালুর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। গত ২৭ এপ্রিল দেশের ৫১টির মধ্যে ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে আটটি সিলেটের। তবে সংরক্ষিত এলাকা, পর্যটনকেন্দ্র ও কোয়ারিগুলোর পাথর লুট ঠেকানো যায়নি। সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনে গত ২৪ জুন জেলা পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কোয়ারি ইজারার দাবিতে মানববন্ধন হয় যেখানে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। সিলেটের পরিবেশকর্মীরা বলেছেন, রাজনীতিবিদদের এই অবস্থান পাথর লুটে উত্সাহ যুগিয়েছে। পাথর লুটপাটের ঘটনার পর নেতারা অবশ্য বলছেন, তারা লুটের পক্ষে নন। একইভাবে পাথর উত্তোলনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর অন্তত ৩১ জনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদন অনুসারে বিএনপির জড়িত ব্যক্তিরা হলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সমপাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সদস্য হাজি কামাল (পাথর ব্যবসায়ী), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সমপাদক সাজ্জাদ হোসেন দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সমপাদক রুবেল আহমেদ বাহার, সহ-সাংগঠনিক সমপাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দপ্তর সমপাদক মো. দুলাল মিয়া দুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, সাজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মী জাকির হোসেন, মোজাফর আলী, মানিক মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সমপাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, কোষাধ্যক্ষ (বহিষ্কৃত) শাহ আলম ওরফে স্বপন, সাংগঠনিক সমপাদক আবুল কাশেম এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে জড়িতরা হলেন কোমপানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান। জামায়াতের জড়িতরা হলেন সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফকরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। কোমপানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির আজমান আলী ও জামায়াত নেতা মাস্টার শফিকুরেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সিলেট জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে। এ ছাড়াও স্থানীয় প্রভাবশালী আরো ১১ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। তারা হলেন ভোলাগঞ্জের আনর আলী, উসমান খাঁ, ইকবাল হোসেন আরিফ, দেলোয়ার হোসেন জীবন, আরজান মিয়া, মো. জাকির, আলী আকবর, আলী আব্বাস, মো. জুয়েল, আলমগীর আলম ও মুকাররিম আহমেদ।

এদিকে পরিবেশবাদীদের মতে, সিলেট থেকে অন্তত ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে। প্রতি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট করে হলে ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুটতে প্রয়োজন হয়েছে অন্তত ৮০ হাজার ট্রাক। দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, প্রতি ট্রাকে ১০ হাজার টাকা করে কমিশন পেলে ডিসি-এসপিসহ স্থানীয় প্রশাসনের পকেটে ঢুকেছে অন্তত ৮০ কোটি টাকা। এই লুটপাটে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সঙ্গ দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের প্রায় সব স্তরের কর্মকর্তারা। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, সহকারী কমিশনার (ভুমি), পুলিশ সুপার, থানার ওসি এবং কোম্পানীগঞ্জে দায়িত্বপ্রাপ্ত চার জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সরাসরি মদত ছিল পাথর লুটপাটে।

লুট করা পাথর প্রতি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট করে সরিয়ে নেওয়া হতো। প্রতি ঘনফুট ১৮২ টাকা করে হিসাব করা হতো। সে হিসাবে ট্রাকপ্রতি পাথরের দাম পড়ে ৯১ হাজার টাকা। এখান থেকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা যেত জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা এসপি, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, থানা পুলিশ ও ডিবির পকেটে। এছাড়া নৌকাপ্রতি উত্তোলন করা হতো ১ হাজার টাকা। জেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের মধ্যে ৫ হাজার টাকা করে ভাগ হতো। এছাড়া নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা করে পেতেন তারা। আরো ভাগ পেতেন ইউএনও, এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তহশিলদার। পুলিশের অংশের ভাগ পেতেন এসপি, সার্কেল এসপি, ওসি এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার অন্য পুলিশ কর্মকর্তা ও জেলা ডিবি কর্মকর্তারা। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, সিলেটে প্রতি ঘনফুট পাথর আকার ও ধরনভেদে ৬০ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। লুটপাট করা পাথরের দাম প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ। তবে কোনো হিসাব বা প্রাক্কলন পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন দুদকের কার্যালয়ে জমা পড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবীর বিরুদ্ধে পাথর উত্তোলন বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ আনা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী পাথর লুটে সিলেটের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। তার বিরুদ্ধে সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ পেয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

তাছাড়া সাদাপাথর যেহেতু খনিজ সম্পদ, তাই খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) এ সম্পদ দেখভাল করার কথা। কিন্তু পাথর লুটকাণ্ডে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সে হিসেবে সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা পাথর লুটের অপরাধের জন্য দায়ী।

প্রমাণ ছাড়া দুদক প্রতিবেদন করলে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে :জামায়াত

সাদাপাথর লুটে জামায়াত নেতৃত্বকে জড়িয়ে প্রতিবেদনের কোনো সত্যতা নেই বলে দাবি করেছে জামায়াত ইসলামী। বৃহস্পতিবার নগরীর দলীয় কার্যালয়ে সিলেট জেলা ও মহানগর জামায়াতের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান।

মহানগরের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করেন, পাথর লুটের দুদকের প্রতিবেদনে জামায়াতের কোনো নেতাকর্মীর নাম না থাকার পরও সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশ করছে। জামায়াতে ইসলামী দুদকে খোঁজ নিয়েও এ ধরনের কোনো তদন্ত প্রতিবেদনের হদিস পায়নি। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের রিপোর্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কাল্পনিক ও ফরমায়েশি। তবে প্রমাণ ছাড়া দুদক এ ধরনের প্রতিবেদন করলে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *