Google Alert – প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর নির্বাচন শেষে তিনি রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে সেই সরকারের কোনো পদে তিনি থাকবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেসারেট নিউজে লেখা নিবন্ধে তিনি এমন অভিমত প্রকাশ করেন। গত বছর বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন। বৃহস্পতিবার নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
নিবন্ধে অধ্যাপক ইউনূস লিখেছেন, আমি স্পষ্ট করেছি : জাতীয় নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে। এরপর যে সরকার আসবে, সেখানে নির্বাচিত বা নিযুক্ত করা কোনো পদে আমি থাকব না। আমার সরকারের মূল লক্ষ্য হলো-একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সঙ্গে তাদের সব পরিকল্পনা বলতে পারবে। আমাদের মিশন হলো-সব বৈধ ভোটার যেন তাদের ভোট দিতে পারে, যারা প্রবাসে আছেন তারাও। এটি একটি বড় কাজ। কিন্তু আমরা কাজটি সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অধ্যাপক ইউনূস লিখেছেন, এক বছর আগে এ মাসে বাংলাদেশের হাজার হাজার সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষার্থী, যাদের পেছনে ছিল সমাজের সব স্তরের অগণিত মানুষের সমর্থন, আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ যা শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল তার মাধ্যমেই তারা একজন স্বৈরাচারকে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। এরপর যে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ছাত্রনেতারা আমাকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানান। এ সরকারের দায়িত্ব ছিল দেশকে স্থিতিশীল করা এবং গণতন্ত্রের নতুন পথ তৈরি করা।
শুরুতে আমি রাজি হইনি। কিন্তু যখন তারা জোর করল তখন আমি তরুণদের জীবন উৎসর্গের কথা ভাবলাম-আমি তাদের ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সুশীল সমাজের নেতাদের নিয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে আমি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ গ্রহণ করি। এ গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা থেকে। এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম ‘জেনারেশন জেড’ বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। এ বিপ্লব তরুণদের জন্য একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে, যা দেখায় কীভাবে তারা মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো-যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বৈষম্য মোকাবিলার জন্য এগিয়ে আসতে পারে। তিনি লেখেন, আমরা ভাগ্যবান যে তারা ‘তাদের পালা আসার জন্য’ অপেক্ষা করেনি। যখন সভ্যতা অনেক দিক থেকে ভুল পথে চালিত হচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে আমাদের উত্তরণের একটি স্পষ্ট প্রমাণ ছিল-যখন দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকী বাংলাদেশকে তাদের ‘২০২৪ সালের সেরা দেশ’ হিসাবে ঘোষণা করে। আমরা তখন অর্থনীতি পুনর্গঠন, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং চুরি যাওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ উদ্ধারে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আমরা তখনো বুঝতে পারিনি বিশ্ব আমাদের এ অগ্রগতিকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করছে। ডেসারেট নিউজ আমাদের এ যাত্রার চমৎকার কাভারেজ দিয়েছে, যা আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করি। আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল গণ-অভ্যুত্থানে যারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন এবং যারা গুরুতর আহত হয়েছিলেন-সেই হাজার হাজার পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। এরসঙ্গে আমরা বিগত সরকার ও তার সহযোগীদের লুট করা অর্থ উদ্ধারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।
ড. ইউনূস লিখেছেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী-গত ১৫ বছরে সাবেক স্বৈরাচারী সরকার বছরে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে। এ অর্থ পুনরুদ্ধার করার জন্য লড়াই করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করি-তখন অব্যবস্থাপনার মাত্রা দেখে হতবাক হয়ে যাই। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছিল না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা, যারা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য না দেখানোর কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তারা ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে আমরা পুনর্গঠন শুরু করেছি। যেসব রাজনৈতিক দল স্বৈরাচারের প্রতিরোধ করেছিল তাদের পাশাপাশি নতুন গঠিত দলগুলোও নতুন ধারণা, শক্তি এবং কর্মপ্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সশস্ত্র বাহিনী, যারা ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের ওপর গণহত্যা চালাতে দেয়নি, তারা পেশাদারত্ব বজায় রেখেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। আমি এটি স্পষ্ট করে দিয়েছি, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি এরপরের সরকারের কোনো নির্বাচিত বা নিযুক্ত পদে থাকব না। আমাদের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হলো-একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকসহ সব যোগ্য নাগরিককে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া একটি বিশাল কাজ। কিন্তু আমরা এটি সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন এনেছি। যেন আমাদের প্রতিবেশী এবং বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক জোরদার করা যায়।
বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসাবে, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির একটি মূল কেন্দ্র হতে পারে এবং হওয়া উচিতও। আমরা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞ। সম্প্রতি রুবিওর সঙ্গে আমার একটি ফলপ্রসূ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে; যা আমাদের উভয় দেশের বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক। যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘও আমাদের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। আমরা এ পথে একা নই।
ইউনূস লিখেছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের নিয়ে একটি ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছি। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি সাংবিধানিক সংশোধনী আনা। যা এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে; যাতে বাংলাদেশ আর কখনো স্বৈরাচারী শাসনে ফিরে না যায়। বাংলাদেশ যদি শেষ পর্যন্ত এমন একটি দেশে পরিণত হয়; যেখানে দেশের সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। তবে তা হবে লাখ লাখ বাংলাদেশির দৃঢ়তা, কল্পনা এবং সাহসের ফল। এ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে যারা আছেন তাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে। তারাই আমাদের সর্বোত্তম আশা ও সম্ভবত আমাদের শেষ আশা।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ডেসারেট নিউজে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লেখা নিবন্ধের অনুবাদ। (সংক্ষেপিত)।