The Daily Ittefaq
রূপলাল রবিদাস পেশায় ছিলেন একজন মুচি। নিজে এই কাজ করলেও তার স্বপ্ন ছিল ছেলে জয় রবিদাস বড় হয়ে হবেন স্কুল শিক্ষক, শিক্ষার আলো ছড়াবে গ্রামজুড়ে। তবে নির্মম পরিহাস; চোর সন্দেহে রূপলালকে পিটিয়ে হত্যার পর সংসারের হাল ধরতে স্কুলের বেঞ্চ ছেড়েছে জয়। এখন প্রতিদিনই রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারে একটি চৌকিতে বসে জুতা সেলাই করতে দেখা যায় তাকে।
একসময় সেই টুলে বসতেন রূপলাল। পেশায় তিনি ছিলেন জুতা সেলাইকারী। এই কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। গত ৯ আগস্ট রাতে ভ্যানচোর সন্দেহে তাকেসহ দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই থেকেই সংসারের হাল ধরার দায়িত্ব এসে পেড়েছে নবম শ্রেণির ছাত্র জয় রবিদাসের ওপর। বই-খাতার বদলে তার সামনে এখন হাতুড়ি, সুতা আর পালিশের কৌটা।
জয়ের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর গ্রামে। সে তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। বাবাকে হারিয়ে সেই স্বপ্ন থেমে গেছে তার।
জয় জানায়, সকাল ১০টায় দোকান খুলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জুতা সেলাই, জুতা রং কাজ করলে ৩০০ টাকার মতো আয় হয়। জুতা বানাতে পারলে আয় আরও বাড়বে। তবে ৩০০ টাকায় কুলায় না। মা, দুই বোন, দাদিসহ তাদের পাঁচজনের সংসার এই টাকায় চালাতে টানাটানি হয়।
সুই গেঁথে জুতায় ফোঁড় দিতে দিতে জয় বলে,‘বাবা কত কষ্ট করত, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যখন যেটা চাইছি, কখনো বাবা না করে নাই। এখানে বসে থাকতে কোমর লেগে যায়, পা অবশ হয়ে আসে। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এই কষ্ট হতো না। আমি স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করতাম। বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে শিক্ষক দেখার। কিন্তু আমি এখন সুই হাতে জুতা সেলাই করছি। উপায় নেই, সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন বাবা। এখন মা, ঠাকুরমা আর দুই বোনকে নিয়ে সংসার চালাতে হবে আমাকে। আমার পড়াশোনা হবে কি না জানি না, তবে দুই বোনকে পড়াতে চাই। পরিবারকে সুখে রাখতে চাই।’
তারাগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ সড়কের ধারে স্থানীয় ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে রূপলাল তার দোকানের সামনে ছোট কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। রূপলাল প্রায় গর্ব করে বলতেন, ছেলে লেখাপড়ায় ভালো। পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেলে পরিবারের কষ্ট দূর হবে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ছেলে এখন সেই জায়গায় জুতা সেলাই করছে।
জয়ের মা ভারতী রানী বলেন, ছোট মেয়েটা মাছ দিয়ে ভাত খেতে চায়। তাকে মাছ দিব কিভাবে। ঘরে আমার ওষুধের টাকা নেই। মেয়ের বিয়ে নিয়েও চিন্তায় আছি। আমার ছোট ছেলেটা স্কুল বাদ দিয়ে জুতা সেলাই করতে যাচ্ছে। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুসা সরকার বলেন, খুব খারাপ লাগছে জয়কে কাজ করতে দেখে। তার বাবাকে আজ মব সৃষ্টি করে যদি মেরে ফেলা না হতো, তাহলে তাকে ক্লাস ছেড়ে বাজারে জুতা সেলাই করতে হতো না। আমরা তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করব, সে যাতে ক্লাস–পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।
গত ৯ আগস্ট রাতে রূপলাল রবিদাস ও তার ভাগনি জামাই প্রদীপ লাল রবিদাস (৪৭) ব্যাটারিচালিত ভ্যানে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তারাগঞ্জের বুড়িরহাট বটতলায় তাদের ভ্যানচোর সন্দেহে আটক করেন স্থানীয় লোকজন। এরপর তাদের দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরের দিন রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী তারাগঞ্জ থানায় মামলা করেন। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুক বলেন, গ্রেপ্তার ছয়জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) রুবেল রানা বলেন, রূপলালের পরিবারকে কয়েক দিন আগে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আরও সহযোগিতার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।