বিএনপির প্রয়োজনীয়তা | দৈনিক নয়া দিগন্ত

Google Alert – সামরিক

একটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কেবল ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস নয়, এটি জাতির আকাক্সক্ষা, সঙ্কট ও সম্ভাবনারও দলিল। সেই দলিলের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। যে দিনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্বাসন ও একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনার সাক্ষী হয়ে আছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির প্রতিষ্ঠা কেবল একটি দলের জন্ম নয়, এটি ছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার ফসল।

১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর একদলীয় শাসনামল শেষে দেশ যখন একটি রাজনৈতিক শূন্যতায় নিপতিত, তখন গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। একটি শক্তিশালী ও সংগঠিত বিকল্পের অনুপস্থিতি তখন স্পষ্ট। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীসহ অনেক প্রবীণ নেতা তখনো সক্রিয় থাকলেও, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সুসংগঠিত, সুস্পষ্ট আদর্শভিত্তিক এবং সর্বজনীন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের। এই শূন্যতা পূরণ করতেই আত্মপ্রকাশ করে বিএনপি। এর প্রতিষ্ঠাতা, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, তা ছিল একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে যুগোপযোগী দার্শনিক ভিত্তি। এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সব নাগরিকের সমান অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা। সংখ্যালঘু নাগরিকদের সমান অংশগ্রহণের রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবেও বিএনপি সামনে আসে।

স্বাধীনতার ঘোষক থেকে রাষ্ট্রনায়ক

কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা তাকে জনমানসে প্রথম পরিচিতি এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অফিসার হিসেবে তাকে স্বীকৃতি এনে দেয়। নয় মাসের যুদ্ধে তিনি ছিলেন ‘জেড ফোর্স’-এর ব্রিগেড কমান্ডার। স্বাধীনতার পর তিনি দক্ষ সামরিক অফিসার হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালের অস্থির সময়ে ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া… আপনারা ধৈর্য ধরুন’-এই বার্তা তখনকার সঙ্কটকালে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনে।

রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা

রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান প্রথমেই সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক পুনর্গঠন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। সামরিক বাজেট বৃদ্ধি, নতুন ডিভিশন গঠন, পুলিশ ও গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করার পদক্ষেপ ছিল তার রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল। কিন্তু এর চেয়েও বড় পদক্ষেপ ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন। একদলীয় শাসনের সঙ্কট থেকে বেরিয়ে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের বৈধতা দেন। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল বিধি জারি হলে আওয়ামী লীগ, বাম ও ডানপন্থী শক্তিগুলো পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়।

বিএনপির জন্ম : গণতান্ত্রিক ভিত্তি

এই সময়েই জন্ম নেয় বিএনপি। বহুদলীয় রাজনীতির একটি প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে জিয়া ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশজুড়ে গণসংযোগে বের হয়ে ৭০টিরও বেশি জনসভায় ভাষণ দেন। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করেন। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচন জনগণের ভোটাধিকারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থান

জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি ছিল বাস্তববাদী। ভারতের সাথে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়ন, চীন ও পশ্চিমাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেন। বিশেষত মুসলিম বিশ্বের সংহতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন দৃঢ়।

অর্থনীতি ও সমাজে সংস্কার

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার আমলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য আসে।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী

১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রণীত সব আইন ঘোষণা সাংবিধানিক বৈধতা পায়। এ সংশোধনীতে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিতেও পরিবর্তন আসে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পরিবর্তে যুক্ত হয় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। জাতীয়তাবাদ নতুন সংজ্ঞা পায় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। বহুত্ববাদী সমাজে জাতীয় পরিচয়কে নতুন মাত্রা দেয় এই ধারণা। মুসলিম বিশ্বের সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়।

ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক ও উত্তরাধিকার

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মাত্র সাড়ে চার বছরে তিনি যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন, তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারে বেগম খালেদা জিয়া একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘৩১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে বাংলাদেশকে মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন।

বর্তমান সঙ্কট ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিএনপির যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলটি বড় আঘাত সহ্য করেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জটিলতা, নেতৃত্বের ওপর দমননীতি, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস, সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে। তার পরও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ধারাবাহিক আন্দোলন প্রমাণ করেছে, বিকল্প শক্তি হিসেবে বিএনপি এখনো জনগণের প্রত্যাশার জায়গায় রয়েছে। বিশেষত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে তারা গণতন্ত্রের প্রশ্নে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে পেরেছে। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ সংগঠনকে নতুন প্রজন্মের সাথে সংযুক্ত করা, গণ-আন্দোলনকে ভোটে রূপান্তর করা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে এই লক্ষ্যগুলোতে সফল হলে বিএনপি আবারো জাতীয় রাজনীতির প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে পারবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি শুধু একটি দলের নাম নয়, বরং রাষ্ট্রের বিকল্প দর্শন ও গণতন্ত্রের প্রতীক। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে ৯০-এর গণ-আন্দোলন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কিংবা সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান সবক্ষেত্রেই বিএনপি নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য দলটি অপরিহার্য।হ

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *