Google Alert – সামরিক
কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীরা দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা ঘটাচ্ছে। এমন অবস্থাতেও ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলের নেতারা বিষয়টি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। শেখ হাসিনার দোসররা সরকারি কর্মচারীদের দাবিদাওয়া আদায়ের মিছিলে নেতৃত্ব দিলেও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলো ভ্রুক্ষেপহীন। অথচ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা পেলে তাদের আবারো ১৯৯৬ সালের আমলাবিদ্রোহের মতো ঘটনার মুখে পড়তে হতে পারে তা বেমালুম ভুলে গেছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা ২০০৯-১০ থেকে সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দূরে থাক, প্রতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০-৯২ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় করেছেন। সেই তারাও দাবি আদায়ে অর্থবছরের শেষে কর্মবিরতিতে অংশ নেন। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলেও বেতনভাতা ও সরকার পরিচালনার ব্যয় প্রতি বছর বাজেট নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে বেশি।
গত এক বছর ধরে রাজনৈতিক দল ও সরকারি কর্মচারীদের দাবির বহর ক্রমাগত বাড়ছে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে সব দলকে অবশ্যই ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। নির্বাচনে জয়ী দলকে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে ১৯৬৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একটি সংলাপও সফল না হওয়ার খেসারত জনগণকেই দিতে হয়েছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান আহূত ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় একই বছরের ২৪ মার্চ দেশকে দ্বিতীয়বার সামরিক শাসনের কবলে পড়তে হয়েছিল। দুই বছর পর ১৯৭১ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান-শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলী ভুট্রোর মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপ ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে গড়ায়। বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা আসে; কিন্তু এর কুফল ছিল পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমির কারণে ভারতীয় আধিপত্যবাদ জেঁকে বসেছিল। জেনারেল এরশাদের সাথে রাজনৈতিক দলের ১৯৮৪ সালের এপ্রিলের সংলাপ ব্যর্থ হওয়ায় জনগণকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ৯ মের কারচুপির সংসদ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভাজনের রাজনীতির সুযোগ গ্রহণ করে জেনারেল এরশাদ প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। তাকে হটাতে দীর্ঘ ছয় বছর আন্দোলন করতে হয়েছিল। নব্বইয়ে গণ-আন্দোলনে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তিন বছর তিন মাস পরই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়। সঙ্কট নিরসনে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেনের মধ্যস্থতায় ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সংলাপ ব্যর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ওয়ার্কার্স পার্টির ১৪৭ জন এমপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তা সমাধানে ১৭৩ দিন হরতাল ও সরকারি কর্মচারীদের বিদ্রোহ ঘোষণায় দেশ অচল হয়ে পড়ে। এর খেসারত জনগণকেই দিতে হয়েছিল।
সংসদ থেকে পদত্যাগের কারণে তত্ত¡াবধায়ক সরকার বাতিলের সংসদীয় ক্ষমতা না থাকা সত্তে¡ও মাত্র ১৫ বছর পরে ৩০ জুন ২০১১ তারিখে আওয়ামী লীগ, জাপা ও ওয়ার্কার্স পার্টি সংসদে ভোট দিয়ে তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এভাবে আওয়ামী লীগ ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট ২০২৪) পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল।
একই অপরাধে আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের শীর্ষনেতাদের অনেকে কারাবন্দী থাকলেও ২০২৪-এর ডামি নির্বাচনে জয়ী জাপার ১১ জন এমপি জেলের বাইরে কেন? জুলাই-৩৬-এর আন্দোলন চলাকালীন ১৬ জুলাই থেকে প্রতিদিন প্রায় শতপ্রাণ ঝরে পড়লেও এর প্রতিবাদে জাপার একজন এমপিও পদত্যাগ করেননি। কারণ তারা আশায় ছিলেন, যদি শেখ হাসিনার সরকার টিকে যায় তাহলে আরো ৫৪ মাস ক্ষমতার মজা লুটা যাবে। ২০০৭ সালের নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মরহুম আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুল জলিলের মধ্যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার কুফল ছিল ওয়ান-ইলেভেন সরকার ও ভারতের আধিপত্যবাদ ১৯৭২ সালের মতো পুনরায় জেঁকে বসা। সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার কারণে দুই দলের মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদককে পদ হারাতে হয়েছিল।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বাই প্রডাক্ট ছিল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার। সেই সরকারের অপশাসন থেকে ও তার মদদদাতা ভারতের আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পেতেই সংঘটিত হয়েছিল জুলাই-৩৬-এর গণ-অভ্যুত্থান। এর সুফল হচ্ছে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
দুঃখজনক যে, গণ-অভ্যুত্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নেয়নি। তারা অতীতের মতো পরস্পরের বিরুদ্ধে বাগযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। যার ফলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ও তার গঠিত কমিশনের সাথে ম্যারাথন সংলাপ হলেও রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যে গুরুদায়িত্ব চেপেছে তা নেতারা কিভাবে পালন করেন তা দেখার অপেক্ষায় আছেন জনগণ। সংস্কার ও আগামী নির্বাচন নিয়ে সব দলকে অবশ্যই ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই।
আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলের সরকারের সুশাসনের ওপর জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে। আগামী ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দেশ যদি গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয় তাহলে বিদেশে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের অনেকেরই বিদেশের মাটিতেই সমাহিত হতে হবে। প্রবীণ নেতাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবেন তারাও বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় তাদের অবস্থা হবে সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের মতো। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলনকারী, তাদের সমর্থক ও তাদের অনুজদের মধ্যে ভবিষ্যতে আওয়ামীপ্রীতি জেগে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ বিধায় আওয়ামী লীগকেও মুসলিম লীগের ভাগ্য বরণ করতে হবে। নবগঠিত এনসিপির অবস্থা জাসদের মতো হবে না তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের উত্থান ঘটবে, তা-ও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দৃশ্যমান হবে।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনের কারণে বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর যে ভঙ্গুর অবস্থা হয়েছে তাতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা সম্ভব না হলেও অন্তত সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আগামী অক্টোবরে হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। কারণ ছয় মাস পরই জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশের সক্ষমতা ও দক্ষতা গত এক বছরে বৃদ্ধি যে পেয়েছে তার একটি পরীক্ষা জাতীয় নির্বাচনের আগেই হওয়া উচিত। অপর দিকে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন, নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় এবং ভোট গ্রহণকালীন কেন্দ্র দখলের মতো অতীতের ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে কি না তা-ও প্রমাণিত হয়ে যাবে। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে যারা জনগণের দোহাই দিয়ে বড় গলায় কথা বলছেন, তাদের জনপ্রিয়তাও যাচাই হয়ে যাবে।
চারটি প্রদেশ গঠন ব্যতীত এককেন্দ্রিক সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার নামে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা ফলদায়ক না-ও হতে পারে। কারণ তা শুধু রাজনৈতিক অচলাবস্থা বৃদ্ধি করবে না, অন্য দলের ব্যানারে স্বৈরাচারের সমর্থকদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন ঘটাতে পারে। আওয়ামী লীগ যেকোনো একটি দলের প্রার্থীদেরকে সমর্থন দিয়ে সেই দলকে দ্বিতীয় স্থান পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। শেখ হাসিনার সবুজ সঙ্কেত পেয়েই হয়তো জাপার ব্যারিস্টার আনিস সম্মেলন করেছেন। কাজেই ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মতো ২০২৬ ও ২০৩১ সালের নির্বাচনও তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া উচিত।
আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। অনেক নেতাকে পতিত সরকারের নেতাদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের পাহারাদারের ভ‚মিকায় নামতে দেখা যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় তারা লুটপাট করে অর্জিত বিশাল অঙ্কের নগদ টাকা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছে। স্বৈরাচারের যেসব দোসর সরকারি চাকরিতে আছেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন, তাদেরকে চাকরিচ্যুত না করার খেসারত একদিন দিতে হতে পারে।
১৯৫৪-৫৮ সময়ে যুক্তফ্রন্টের অংশীদার আওয়ামী লীগ, কেএসপি ও নেজামে ইসলামের কোন্দলের কারণে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে শুধু সামরিক শাসন টেনে আনেনি, বাহাত্তরের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের সংযোজনের কুফল আজো ভোগ করতে হচ্ছে। চারদলীয় জোট ২০০৬ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল, ২০০৭ সালের প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে জয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার কারণে। তাদের এই ব্যর্থতার খেসারত সাড়ে ১৭ বছর ধরে শুধু তাদেরকে দিতে হয়নি, জনগণকেও দিতে হয়েছে। তাই অতীতের দুঃখময় স্মৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সবাই গণতন্ত্রে উত্তরণে সমঝোতার পথে এগোবেন, এটিই জনগণের প্রত্যাশা।