বিশ্বকে সমর শক্তির চমক দেখাল চীন

Google Alert – সামরিক

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কোয়ার বুধবার পরিণত হয়েছিল এক মহা সমরাঙ্গনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত মহাপ্যারেডে সর্বাধুনিক সামরিক ক্ষমতার ঝলক দেখিয়েছে দেশটি। আকাশ, সমুদ্র ও স্থল-তিন স্থরের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শিত হয়েছে একসঙ্গেই। সর্বাধুনিক স্টেলথ ফাইটার জেট, অত্যাধুনিক ড্রোন, ট্যাংক, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা যুদ্ধাস্ত্রের সমারোহে একেবারে ভিন্ন, এক শক্তিশালী রূপ দেখিয়েছে চীন।

এদিন কুচকাওয়াজে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার সেনা। সবমিলিয়ে বিশ্বকে আধুনিক সমরশক্তির চমক দেখাল চীন। এ আয়োজনের নেতৃত্ব দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান শি জিনপিং। এএফপি, রয়টার্স।

দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) : চীন তাদের সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম দীর্ঘপাল্লার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ডিএফ-৫সি উন্মোচন করেছে। বুধবার অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে এই ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রথমবারের মতো প্রদর্শন করা হয়। ডিএফ-৫সি হলো তরল জ্বালানিচালিত এক বিশাল পারমাণবিক অস্ত্র, যা চীনের বহুল পরিচিত ‘ডংফেং’ ক্ষেপণাস্ত্র সিরিজের অংশ। চীনা সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, এই ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর যে কোনো স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম। এছাড়া ডিএফ-২৬ডি এবং ডিএফ-৬১-ও প্রদর্শন করা হয়। ‘গুয়াম কিলার’ নামে পরিচিত আইসিবিএম ডিএফ-৬১ মার্কিন প্রধান নৌ-ঘাঁটি গুয়ামে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম। এই আইসিবিএমগুলো চীনের অস্ত্রগারে নতুন সংযোজন।

পানির নিচের ড্রোন : চীনের কুচকাওয়াজে এবার দেখানো হয়েছে দুটি নতুন পানির নিচের ড্রোন-এজেএক্স-০০২ এবং এইচএসইউ-১০০। এই বিশাল সাবমেরিনের মতো ড্রোনগুলো ১৮ থেকে ২০ মিটার গভীরে চলতে সক্ষম এবং শত্রু নৌবাহিনী বা সাবমেরিনের ওপর হামলার সময় কমান্ড ও কন্ট্রোল এবং নজরদারি মিশনে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এজেএক্স-০০২ নজরদারির কাজে ব্যবহার হতে পারে। আর এইচএসইউ-১০০ নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, এটি পানির নিচে মাইন বসানোর জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।

সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র : কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত হয় চারটি নতুন সুপারসনিক বা অ্যান্টি-শিপ মিসাইল-ওয়াইজে-১৫, ওয়াইজে-১৭, ওয়াইজে-১৯ এবং ওয়াইজে-২০। এগুলোকে ‘ইয়িং জি’ বা চীনা ভাষায় ‘ইগলের আক্রমণ’ নাম দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো জাহাজ বা যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া যায় এবং বড় আকারের নৌযান ধ্বংস করতে সক্ষম। এর মধ্যে ওয়াইজে-১৭, ওয়াইজে-১৯ এবং ওয়াইজে-২০ হাইপারসনিক বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ এগুলো শব্দের গতির কমপক্ষে পাঁচগুণ দ্রুত গতিতে উড়তে সক্ষম।

লেজার অস্ত্র : কুচকাওয়াজের আগেই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে চীনের নতুন লেজার অস্ত্র। বুধবার কুচকাওয়াজে দেখা যায়, একটি ৮ চাকার এইচ-জেড ১৫৫ সাঁজোয়া যানের ওপর স্থাপিত বড় আকারের সাদা রঙের যন্ত্র এলওয়াই-১। যার সঙ্গে গভীর নীল স্ক্রিন লাগানো ছিল। সামরিক সূত্রের দাবি-এটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী লেজারভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নীলের মতে, এই লেজার অস্ত্রটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ধ্বংস করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রও বর্তমানে একই ধরনের ‘ডাইরেক্টেড-এনার্জি অস্ত্র’ নিয়ে কাজ করছে। এসব অস্ত্র তুলনামূলক কম খরচে এবং অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মারাত্মক ক্ষতি করতে সক্ষম।

মানববিহীন যান : পানির নিচের ড্রোন ছাড়াও কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত হয়েছে বেশকিছু মানববিহীন যান। এর মধ্যে ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠে চলাচলকারী ড্রোন জাহাজ। যা নৌবাহিনীর অভিযানে ব্যবহার করা যাবে। এই ড্রোন জাহাজ প্রয়োজনে মানবচালিত হিসাবেও বন্দরে ঢোকা ও বের হওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।

‘রোবোট নেকড়ে’ : চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে এবার নজর কাড়েছে নতুন রোবোটিক উলফ বা ‘রোবোট নেকড়ে’-চার পায়ের যান্ত্রিক রোবট। বিশেষজ্ঞদের মতে, নজরদারি, মাইন শনাক্ত ও পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে শত্রু সেনাদের খুঁজে বের করা পর্যন্ত নানা কাজে ব্যবহার হতে পারে এই ‘রোবোট সেনা’রা। এর আগে ছিল রোবোটিক ডগ, যা গত বছর কম্বোডিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় উন্মোচন করা হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রীয় মিডিয়া জানিয়েছে, নতুন উলফগুলোতে উন্নত যুদ্ধদক্ষতা ও আঘাত করার ক্ষমতা রয়েছে এবং ক্যামেরা সংযোজনের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুতে আরও নির্ভুল আক্রমণ চালানো সম্ভব।

জেট ফাইটার : চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে নতুন স্টেলথ জেট ফাইটার, যেমন দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট জে-৩৫, এবং এইচ-৬ বোমারবিমান উড়তে দেখা যায় যা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। আকাশ প্রদর্শনীতে প্রায় ১০০টির বেশি বিমান অংশ নেয়। যার মধ্যে ছিল কমান্ড ও কন্ট্রোল বিমান এবং চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট জেট ট্রান্সপোর্ট বিমান। এছাড়া একটি হেলিকপ্টার বহর। যা চীনের জাতীয় পতাকা বহন করছিল। যা এমনভাবে উড়ানো হয়েছে যে আকাশে ‘৮০’ সংখ্যাটি স্পষ্ট দেখা গেছে। কিছু হেলিকপ্টারে প্রদর্শিত পতাকায় লেখা ছিল ‘শান্তির জয় হবে’, ‘জনগণ জয়ী হবে’ এবং ‘ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে’। এছাড়া প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আনা হয় কেজে-৬০০ প্রাথমিক সতর্কীকরণ বিমান।

এয়ার ড্রোন ও ‘লয়াল উইংম্যান’ : চীন হতে পারে প্রথম দেশ যে ‘লয়াল উইংম্যান’ ড্রোন ব্যবহার করছে। এটি মানবচালিত ফাইটার জেট বা বোমারু বিমানের সঙ্গে উড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায্যে কাজ করে। নজরদারি এবং আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা বহন করে আক্রমণ চালানো এই ড্রোনের কাজ।

আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : কুচকাওয়াজে ছয় ধরনের আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রদর্শিত হয়েছে: এইচ-১১, এইচ-৯সি, এইচ-১৯, এইচ-২০, এইচ-২২এ এবং এইচ-২৯। এর মধ্যে এইচ-২০, এইচ-২২এ এবং এইচ-২৯ প্রথমবার জনসমক্ষে দেখানো হয়েছে। এইচ-১১, এইচ-২০ এবং এইচ-২২এ মূলত বিমান, ড্রোন, ক্রুজ ও স্বল্প ও মধ্য-পরিসরের ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। এইচ-৯সি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে রক্ষা করতে এবং নিম্ন উচ্চতায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম। এইচ-২৯ সবচেয়ে বড় সারফেস-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম। যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে মধ্যম পর্যায়ের হুমকি প্রতিরোধ করতে সক্ষম।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফোরামের গবেষক আলেকজান্ডার নিল বলেছেন, চীন তার ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট বাহিনীকে কৌশলগত প্রতিরোধের মূল অংশ হিসাবে গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর আধিপত্যের পালটা ভারসাম্য তৈরি করাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য বলে মনে করেন তিনি।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *