খাসকামরা যেন ‘ঘুষের হাট’

দেশ রূপান্তর

ইচ্ছেমতো আসেন অফিসে। ঘুষ ছাড়া দলিল রেজিস্ট্রি করেন না। দলিল দাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তো কথাই নেই। দাবি করেন মোটা অঙ্কের টাকা। দলিল লেখকদের মাধ্যমে ঘুষের টাকা লেনদের করেন খাসকামরায় বসে। দলিল লেখক ও দাতা-গ্রহীতাদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ। যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ তিনি হলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা ফতেয়াবাদ কার্যালয়ের সাব-রেজিস্ট্রার শর্মি পালিত। তার বিরুদ্ধে আইন উপদেষ্টার কাছে ভুক্তভোগীদের দেওয়া লিখিত অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গত ৩১ আগস্ট তার কার্যালয়ে সাব-রেজিস্ট্রার শর্মি পালিত দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারি না। তবু বলিÑ কারও স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে আমার বিরুদ্ধে আইন উপদেষ্টার কাছে অভিযোগ দিতেই পারেন। তবে সেই অভিযোগ সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করে দেখবেন। আমি নিয়ম মেনেই দলিল নিবন্ধন করছি। কারও সঙ্গে অসদাচরণের প্রশ্নই আসে না। দলিল নিবন্ধনে দলিল লেখকদের মাধ্যমে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।’

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফতেয়াবাদ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দায়িত্ব নেন শর্মি পালিত। এর আগে তিনি দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। তবে উক্ত অফিসে দুর্নীতির দায়ে দলিল লেখকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ২০২২ সালের ৮ আগস্ট ক্ষমতার অপব্যবহার করে অফিস ফাঁকি, অসদাচরণ ও ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় নিবন্ধন মহাপরিদর্শকের কার্যালয়  থেকে শোকজ করা হয়েছিল শর্মি পালিতকে। তার বিরুদ্ধে এজলাসে না বসে খাস কামরায় বসে দলিল সম্পাদনের নামে দলিল লেখকদের মাধ্যমে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না তিনি। অফিসে আসেন দুপুর ১২টার পর। আবার ইচ্ছামতো চলে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগী ফতেয়াবাদ পূর্ব ছড়ারকুলের মৃত মো. শফির ছেলে প্রবাসী মো. ইছমাইল জানান, চিকিৎসার প্রয়োজনে সম্প্রতি তিনি দেশে আসেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া  হাটহাজারীর দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার (বিএস ৩১৩১ দাগ) দুই শতক জমি বিক্রির জন্য ক্রেতার সঙ্গে দরদাম ঠিক হয় তার। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রিতে বিপত্তি তার পাসপোর্টে মায়ের নাম ভুল প্রিন্ট হওয়ায়। তার মায়ের প্রকৃত নাম শামসুন নাহার। কিন্তু পাসপোর্টে হয়ে যায় ‘ফাতেমা’। জমি রেজিস্ট্রি দিতে চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে সম্প্রতি একটি হলফনামা সম্পাদন করেন ইছমাইল। দলিলে হলফনামার বিষয়টি উল্লেখ করেন দলিল লেখক মো. সেকান্দর। দলিলটি নিবন্ধন করতে গত ১৮ আগস্ট শর্মি পালিতের কাছে যান ইছমাইল। কিন্তু আদালতের হলফনামাকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য ও অমান্য করে দলিলটি নিবন্ধনে অপারগতা প্রকাশ করেন সাব-রেজিস্ট্রার শর্মি পালিত। শেষ পর্যন্ত দলিল নিবন্ধন না করেই চলে যান ইছমাইল। একই দিন উপজেলা সদর রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে ওই দলিল নিবন্ধন করান দলিল লেখক মো. সেকান্দর। প্রবাসী মো. ইছমাইল বলেন, ‘দাবি মতো ঘুষ দিতে না পারায় সাব-রেজিস্ট্রার শর্মি পালিত আমাদের দলিল অজুহাত দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করতে অসম্মতি জানান। আমি হয়রানির শিকার হয়েছি।’

সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও কোনো অজুহাত ছাড়াই দলিল রেজিস্ট্রি না করে সেবা প্রার্থীদের চরম হয়রানি, দলিল লেখক, দাতা-গ্রহীতার সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বিশেষ করে দলিল সম্পাদনে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করে ফতেয়াবাদ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, সাব- রেজিস্ট্রার শর্মি পালিতের অনিয়ম-অসদাচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্ব্যবহারের কারণে কমে গেছে দলিল রেজিস্ট্রি। ২০২৪ সালে দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার। শর্মি পালিত দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিগত প্রায় ৮ মাসে দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ২০০। একজন দলিল লেখক অভিযোগ করেন, বণ্টননামা দলিলে সরকার নির্ধারিত নিবন্ধন ফি সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা। তিনি (শর্মি পালিত) নেন ১ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। সাব-রেজিস্ট্রার শর্মি পালিতের অনিয়ম-দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি বাহার উদ্দিন নামে উক্ত অফিসের এক কর্মচারী স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে চলে যান সদর রেজিস্ট্রি অফিসে।

জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ফতেয়াবাদ কার্যালয়ের সাব- রেজিস্ট্রার শর্মি পালিতের গ্রামের বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলায়। ফতেয়াবাদ কার্যালয়ের আগে তিনি সাব-রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন চন্দনাইশের গাছবাড়িয়ায়। একই জেলায় বদলির নিয়ম না থাকলেও শর্মি পালিতের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় কেনÑ প্রশ্ন রাখেন ওই কর্মকর্তা। ফতেয়াবাদ দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মো. সালাউদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রার শর্মি পালিতের কারণে ফতেয়াবাদের ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে। তার আচার-ব্যবহারের কারণে অত্র অফিসের দলিল লেখকরা হাটহাজারী সদরমুখী হচ্ছে। নানা অজুহাতে তিনি সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করেন।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলূর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফতেয়াবাদের সাব-রেজিস্ট্রার শর্মি পালিতের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা আইন উপদেষ্টার কাছে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দিলে সেটা আইন উপদেষ্টার দপ্তর দেখবে। তবে আমার কাছে তার (শর্মি পালিত) অভিযোগ এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ 

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *