Samakal | Rss Feed
স্মৃতি, ইতিহাস ও সংগ্রামের দলিল
কালের খেয়া
লাবণী মণ্ডল 2025-09-26
১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম কেবল যুদ্ধ নয়; এটি দীর্ঘদিনের বৈষম্য, ভাষা-সংস্কৃতির অবমাননা ও রাজনৈতিক প্রতারণার প্রতিফল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। পরিণতিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর হত্যাযজ্ঞ মানুষকে ঠেলে দেয় মুক্তির যুদ্ধের দিকে। সাংবাদিক ও গবেষক সালেক খোকনের বই গৌরব ও বেদনার একাত্তর আমাদের সামনে তুলে ধরেন সেই ইতিহাসের অচেনা অংশ। তিনি মাঠপর্যায়ে ঘুরে প্রত্যক্ষদর্শী, শহীদ–স্বজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ান সংগ্রহ করেছেন। ফলে বইটি আবেগের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল।
লেখক শুরুতেই মনে করিয়ে দেন, ‘একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস।’ তাঁর বইয়ে দুটি স্তর স্পষ্ট–গণহত্যার কেস স্টাডি ও মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনকথা।
রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি, সিলেটের কাইয়ার গুদাম, সৈয়দপুর, সিরাজগঞ্জসহ আটটি হত্যাযজ্ঞ বইটিতে স্থান পেয়েছে। সিরাজগঞ্জ অধ্যায়ে আমরা দেখি–১৮ মে সেনারা এক ভিখারীর মুখে হিন্দুপাড়ার অবস্থান জেনে মুহূর্তে নিঃশেষ করে দেয় কয়েকটি পরিবারকে। এই বয়ান শুধু নৃশংসতার দলিল নয়; এটি মানুষের অসহায়তার ইতিহাস।
তিনি দেখিয়েছেন, হত্যাযজ্ঞ কেবল সেনাদের হাতে হয়নি; স্থানীয় দোসররা অনেক সময় গাইড ও সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর ভাষায়–যুদ্ধ শুধু সীমান্তে নয়, ঘরের উঠানেও লড়াই হয়েছিল। ‘শরণার্থী’ অধ্যায় মনে করিয়ে দেয় সেই সময়ের দুর্ভোগ। সীমান্ত পেরিয়ে এক কোটির বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। লেখক উদ্ধৃত করেছেন ভারতীয় এক কর্নেলের কথা, ‘তোমাদের দেশ তোমাদেরই স্বাধীন করতে হবে।’ এই উচ্চারণ বইটির নৈতিক সুর তৈরি করে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে ভয়, ক্ষুধা ও বীরত্বের গল্প। একজন তরুণের স্মৃতি–‘কৃষিকাজ ছাড়াও বাবার ব্যবসা ছিল। কিন্তু ভাতের পরিবর্তে যবের ছাতু, কালাইয়ের ছাতুও খেতে হয়েছে… পরে শুনি আর্মিতে লোক নিচ্ছে।’ দারিদ্র্য আর অস্থির ভবিষ্যৎই তাকে ঠেলে দেয় মুক্তিযুদ্ধে।
রওশন জাহান সাথীর কণ্ঠে শোনা যায় প্রজন্মের প্রতি আহ্বান, ‘দেশকে ভালোবেসো, স্বাধীনতাবিরোধীদের চিনে রেখো… রক্তে পাওয়া এই দেশটাকে তোমাদের হাতেই দিয়ে গেলাম।’ নারীর বয়ান এখানে কেবল ভুক্তভোগীর নয়; নেতৃত্ব ও শিক্ষার প্রতীক।
বইয়ের বড় শক্তি হলো ভাষাশৈলী–সাংবাদিকতার সংযম ও সাহিত্যিক মিতব্যয়। আলোকচিত্র ও দলিল পাঠককে তথ্যের ভেতর দিয়েই আবেগ স্পর্শ করায়। একই সঙ্গে লেখক মনে করিয়ে দেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র এখনও ক্ষমা চায়নি; শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও হয়নি। ফলে প্রশ্ন জাগে–‘স্মৃতির ঋণ কি শুধু ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বরের বক্তৃতায় শোধ হয়?’
আন্তর্জাতিক পরিসরেও ১৯৭১ এখনও ‘জেনোসাইড’ হিসেবে পূর্ণ স্বীকৃতি পায়নি। এ অবস্থায় বইটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দালিলিক ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
গৌরব ও বেদনার একাত্তর শুধু ইতিহাস নয়; এটি ন্যায়, মানবাধিকার ও মানবিকতার পাঠ। স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা যথেষ্ট নয়–তা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিদিনের জীবনে ন্যায় ও সাহসের অনুশীলন করতে হবে। এ কারণেই বইটির প্রাসঙ্গিকতা আজও সমান তীব্র।