মগজের ব্যবহার ‘অপরাধ’ হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট হবে সবচেয়ে নির্দোষ

Google Alert – বাংলাদেশ

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা হাত ফসকে গেল। সঙ্গে শেষ হয়ে গেল ৭ বছর পর আবার এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলার সুযোগও। এই ব্যর্থতার দায় কার? আপনি চাইলে দোষ দিতে পারেন ফিল্ডিংয়ের, কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যে কোনো পিচে ১৩৬ রান তাড়া করতে না পারার ব্যর্থতা আর যাই হোক, ফিল্ডিংয়ের ঘাড়ে চাপানো যায় না; এই দোষ অতি অবশ্যই ব্যাটিংয়েরই। আরেকটু স্পষ্ট করে বললেন, দায়টা ব্যাটারদের ‘মগজ’ ব্যবহার করতে না পারার, ম্যানেজমেন্টের দোষটাও ওখানেই বৈকি! 

ব্যাটারদের আলাপে একটু পরে আসা যাক। আগে ম্যানেজমেন্টের অবিমৃষ্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন বোধ করি। ম্যাচের একাদশে গতকাল মিডল অর্ডার ব্যাটার, যিনি মিডল ওভার সামলাবেন, এমন ব্যাটার ছিলেন মোটে একজন– তিনি তাওহীদ হৃদয়। তার পর যারা এসেছেন গত রাতে, তাদের সবাইকে মিডল অর্ডার না বলে লোয়ার মিডল অর্ডার বলাটাই বেশি যুতসই। এই ‘লোয়ার মিডল অর্ডার’দের তালিকার দৈর্ঘ্যটা দেখুন একবার– শেখ মাহেদী, নুরুল হাসান সোহান, জাকের আলী, শামীম পাটোয়ারী। যে একজন মিডল অর্ডার ব্যাটার ছিলেন, তাকেও ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তের কারণে প্রথম ওভারেই। 

লিটন দাস নেই। এরপর যখন গত রাতে তানজিদ হাসান তামিমকেও বসিয়ে দেওয়া হলো, তখন টপ অর্ডারের প্রকৃত দৈর্ঘ্য হয়ে গেল শুধু ওপেনিং পর্যন্তই। এরপর প্রথম ওভারেই যখন বিদায় নিতে হলো পারভেজ হোসেন ইমনকে, তখন দলের একমাত্র মিডল অর্ডার ব্যাটারকে নামতে হলো ইনিংসের প্রথম ওভারে। হৃদয় শ্রীলঙ্কা ম্যাচে ক্রিজে এসেছিলেন ইনিংসের ৭ম ওভারে, ভারত ম্যাচেও তাই। মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে একজনের উইকেটে সেট হতে সময় লাগবে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটাই স্বাভাবিক। হৃদয় আগের দুই ম্যাচেই সে সুযোগটা পেয়েছেন, কারণ পাওয়ারপ্লে শেষ হওয়ার কারণে ফিল্ডারদের বড় অংশ ছিলেন সীমানার কাছে, সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বিস্তর। সেই তিনি যখন পাওয়ারপ্লেতে নামবেন, ৮ ফিল্ডারকে বৃত্তের ভেতরে দেখে তার ভড়কে যাওয়ারই কথা, সেটা হয়েছেও শেষমেশ। 

এরপর মাঝের ওভারে বাংলাদেশকে যখন চেপে ধরেছে সাইম আয়ুব, আবরার আহমেদ আর মোহাম্মদ নওয়াজের স্পিন, তখন স্পিনের বিপক্ষে তুলনামূলক ভালো খেলা রিশাদ হোসেনকে আনাই হলো না, যাদের পাঠানো হলো, তারা হাঁসফাঁস করলেন খুব করে। অথচ তখন রিশাদের দুটো ছক্কায় হয়তো মোমেন্টাম পক্ষে চলে আসতেও পারত! তারও আগে স্বীকৃত ব্যাটারদের আগেই শেখ মাহেদীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ক্রিজে, কালেভদ্রে নতুন বল সামলানো মাহেদী নাকি ধস সামলাবেন, এই ভেবে! 

ম্যানেজমেন্টের ওসব ভুলই বাংলাদেশকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল। দলের কফিনে শেষ পেরেকটা এরপর ঠুকেছেন ব্যাটাররা। একের পর এক কাণ্ডজ্ঞানহীন শট খেলে খেলে উইকেট জলাঞ্জলি দিয়েছেন, আর তাতেই ১৩৬ রানের লক্ষ্যটাকে এভারেস্টসম ঠেকল, সেই মাঠে, যেখানে ঠিক ৫ দিন আগে ১৬৯ রান তাড়া করেছে বাংলাদেশ। 

ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে প্রয়াত বব উলমার বলেছিলেন ‘এখানে ৩০০ তোলা তো খুব সহজ, বলে বলে একটা করে রান নিলেই তো হলো!’ টি-টোয়েন্টিতে যখন লক্ষ্যটা ওভারপ্রতি ৬ এর আশেপাশে থাকবে, তখনও বিষয়টা একই রকম থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ সে সহজ কাজটা করতে পারল না। ভুল বলা হলো হয়তো, বলতে হবে ‘বাংলাদেশ সহজ কাজটা করতে চাইল না’।

Haris Rauf leapt high after getting Saif Hassan, Bangladesh vs Pakistan, Men's T20 Asia Cup, Dubai, September 25, 2025
সাইফের উইকেটটা কেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল হারিস রউফের উদযাপন দেখেই নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন? ছবি-সংগৃহীত

সাইফ হাসানকেই স্রেফ ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দেওয়া চলে, নিজের মতো করে খেলছিলেন শুরু থেকেই। শ্রীলঙ্কা, ভারতের পর পাকিস্তানকেও হুমকি দিচ্ছিলেন দুটো দারুণ ছক্কা হাঁকিয়ে, সেসবও আবার এসেছে যথার্থ ক্রিকেটীয় শটে। তার সর্বনাশ হলো যে, তাতে তার দোষ আছে সামান্যই। পায়ে আসা বলটা লেগসাইডে খেলতে চেয়েছিলেন, বলটা একটু থেমে ব্যাটে এল যেই না, তা কানায় লেগে চলে গেল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে। ওই মুহূর্তটা তার বিপক্ষে না গেলে তার রাতটা অন্যরকম হতে পারত, কে জানে, হয়তো বাংলাদেশেরও! 

ব্যাটারদের অবিমৃষ্যকারিতা, অদ্ভুত সব আত্মহননেচ্ছার গল্প শুরু হয়েছে অবশ্য সাইফের বিদায়ের অনেক আগে থেকেই। শাহীন আফ্রিদির অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা কী ভেবে যেন টেনে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে খেলতে গেলেন পারভেজ হোসেন ইমন, ক্যাচ দিলেন মোহাম্মদ নওয়াজের হাতে। 

এরপর তাওহীদ হৃদয়েরও তর সইল না তার স্পেলের শেষ ওভারটা দেখে কাটিয়ে দিতে। স্পিনার আসছে, বিষয়টা জানতেন। এই স্পিনারের বিপক্ষেই তার সাবলীল ব্যাটিং বেরিয়ে আসে। এতকিছুর পর সেই স্পিনারদের বল খেলার আগেই ‘মরিবার হলো তার সাধ’, শাহীন আফ্রিদিকে তুলে মারতে গিয়ে ফলস শটে ক্যাচ দিলেন বৃত্তের ভেতরেই। অথচ তার ওয়ানডে মেজাজেরও একটা ৩৫-৪০ রানের ইনিংস পরিস্থিতিটা বাংলাদেশের কবজায় নিয়ে আসতে পারত!

বাংলাদেশ পাওয়ারপ্লেটা শেষ করেছিল ঠিক ৩৬ রান তুলে, ততক্ষণে ৩ উইকেট নেই। পরিস্থিতি যতটা বিরূপ মনে হচ্ছে, ততটাও ছিল না। পরের ১৪ ওভারে রান যে প্রয়োজন ছিল ঠিক ১০০টি। 

‘আমার মনে হয় সবচেয়ে কঠিন বিষয়টা হলো, আপনার মনে হতে পারে আপনি খেলায় পিছিয়ে গেছেন। আপনার মনে হতে পারে এমন, কিন্তু ম্যাচের পরিস্থিতিটাতে আপনি আসলে লড়াইটাকে সমান সমানে নিয়ে আসা থেকে দুই কিংবা তিনটা শট দূরে আছেন।’ 

‘২৩-২৪ ওভারে ৮০ রান বোর্ডে থাকলে আপনি প্যানিক করতেই পারেন। পা হড়কালে আপনি ম্যাচটা ৩০-৩৫ ওভারে হেরে যেতেই পারেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত যদি আপনি ব্যাটিংয়ে থাকতে পারেন, তাহলে ম্যাচটা জেতার খুব ভালো সুযোগই থাকবে আপনার।’ – কথাগুলো দাভিদ মালানের। বছর দুয়েক আগে মিরপুরে সেঞ্চুরি করে ম্যাচ জিতিয়ে বলেছিলেন। 

যদিও ওয়ানডের হিসেব করে বলেছিলেন, তবে বিষয়টাকে টি-টোয়েন্টির ছাঁচে ফেলে ভাবলে আপনার বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, ছোট রান তাড়া করে সফল হওয়ার ব্লুপ্রিন্টই হচ্ছে এটা।

বাংলাদেশের পরবর্তী ব্যাটাররা সেসব হিসেব করেনইনি। প্রত্যেক মিডল অর্ডার ব্যাটার আদ্যন্ত অস্থিরতায় ভুগেছেন। এই স্কুপ মারতে চেষ্টা করছেন, তো এই স্পিনের বিপরীতে গিয়ে লম্বা বাউন্ডারিটাকে টার্গেট করছেন ব্যকরণের নিকুচি করে। দেখে মনে হচ্ছিল, মগজের ব্যবহার যেন ‘অপরাধ’, আর ব্যাটারদের সবাই সে অপরাধের কালিমায় হাত রাঙাতে চাইছেন না! 

স্পিনের বিপরীতে রিশাদের ছক্কা হাঁকানোর সক্ষমতার কথা আগেই দেখে, পড়ে এসেছেন। গেল বছর তার ছক্কা হাঁকানোর ক্ষমতা টের পেয়েছে বাংলাদেশ, তিনি ম্যাচও জিতিয়েছেন দলকে। 

রিশাদ শেষে আফসোসই বাড়িয়েছেন বটে! ছবি- সংগৃহীত

শেষমেশ ভরসা এসে তার ওপরই ঠেকেছিল। শেষ ওভারে হারিস রউফকে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে আফসোসটা তিনি আরও বাড়িয়েইছেন বৈ কমাননি। 

আফসোস জেগেছে— যদি পরিস্থিতিটা পড়ে রিশাদকে আগে নামানোর ভাবনা আসত ম্যানেজমেন্টের মগজে, কিংবা তারও আগে তানজিদ তামিমকে না বসানো হতো, প্রায় অস্তিত্বহীন মিডল অর্ডারের অস্তিত্ব ‘নেই’ না করে দেওয়া হতো এই ম্যাচে! 

তার চেয়ে বড় আফসোসটা জেগেছে অন্য একটা জায়গায়, এত্তো এতো ভুলের পরও শেষ পাঁচ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৫১ রান, টি-টোয়েন্টির বিচারে যা খুবই স্বাভাবিক। উইকেট যদি ধরে রাখতে ব্যাটাররা, তাহলে নিশ্চয়ই এই রানটাকে দুর্লঙ্ঘ্য ঠেকত না!

ম্যাচ শেষে কোচ ফিল সিমন্স যা বলেছেন, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে ম্যানেজমেন্ট আর ব্যাটার দুই পক্ষের অবিবেচক আচরণের দিকেই। সিমন্সের আত্মোপলব্ধি, ‘আমরা ব্যাটিংয়ের ভালো সিদ্ধান্ত নেইনি, শট নির্বাচনও ভালো হয়নি আমাদের।’ 

আত্মোপলব্ধি সবসময়ই উন্নতির দুয়ার খুলে দেয়। অতীতেও এমন আত্মোপলব্ধি অনেক হয়েছে বাংলাদেশের, উন্নতি কতটুকু হয়েছে, তা তো দৃশ্যমান। এবারের আত্মোপলব্ধিও কি একই পরিণতি পাবে? প্রশ্নটা এখন তোলাই যায়।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *