অভ্যন্তরীণ সংকটে পর্যটন খাত

Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল

পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, অপূর্ব ভূবৈচিত্র্যের পার্বত্য অঞ্চল, বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন আর বিচিত্র ধর্ম-বর্ণের মানুষের বৈচিত্র্যময়তা বাংলাদেশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নে দশকের পর দশক ধরে নানা পরিকল্পনা আর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোভাবে তা গতি পায়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে এসে দেশের পর্যটনখাতে মাস্টারপ্ল্যান বা পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেখানেও দেখা দেয় কচ্ছপগতি। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো যাদের পর্যটন সম্পদ সীমিত, সেসব দেশও পর্যটন অর্থনীতিতে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের পর্যটন খাত অদৃশ্য এক শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে আছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২২ সালের ‘ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচক’ অনুযায়ী, বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। গত দুই আড়াই বছরে পর্যটন উন্নয়ন সূচকে ইতিবাচক কোনো সুখবর নেই। উলটো সমন্বয়হীনতা, পর্যটনকেন্দ্রগুলোর দুর্বল অবকাঠামো, অপর্যাপ্ত বিনিয়োগের সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অস্থিরতা পর্যটন খাতের দ্রুত বিকাশে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান কেন্দ্রিক পর্যটন অর্থনীতির বড় স্বপ্ন যেমন অধরা থেকে যাচ্ছে, তেমনি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে।

সমন্বয়হীনতায় এমনিতেই পর্যটন খাতের মহাপরিকল্পনা শুরু থেকেই গতি পাচ্ছে না তার ওপর গত কয়েক বছর ধরে পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তা আর সুরক্ষা নিয়ে গভীর সংকট তৈরি হয়েছে। মাঝে মধ্যেই পর্যটকেরা হয় হামলার শিকার হচ্ছেন, নয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। এতে দেশি পর্যটকদের মধ্যে পর্যটন খাতে সেবা, নিরাপত্তা, সুরক্ষা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। চলতি বছরের ৮-১০ জুন জাফলং পর্যটন স্পটে স্থানীয়দের হামলার শিকার হয়েছেন পর্যটকেরা। তার আগে ফেব্রুয়ারিতে ভোলার ইলিশাবাড়ির রেস্টুরেন্ট ও স্থানীয় পর্যটন পার্কে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চাঁদাবাজি ও হামলার চালায়। এসব ঘটনা পর্যটনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের সাদাপাথর পর্যটন এলাকা ঘিরে যে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে তাতেও পর্যটনখাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকেরই মন্তব্য, জনপ্রতিনিধি আর রাজনৈতিক নেতারা যতদিন না পর্যটনবান্ধব হবেন—ততদিন দেশে পর্যটন খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতেই থাকবে। অপার সম্ভাবনার স্পটগুলোতে পর্যটকবান্ধব পরিবেশের নিশ্চয়তা না থাকলে পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। ফলে খাতসংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান যেমন কমবে, তেমনি সরকারে রাজস্ব আয়ও কমে যেতে থাকবে। যার সার্বিক প্রভাব পড়বে পর্যটন খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে জনপ্রিয় কিছু পর্যটন এলাকায় নেওয়া বড় প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ২০১৮ সালে ৪৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পেলেও গত অর্ধযুগে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারের দেওয়া বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারায় অনেক প্রকল্প থেকে প্রতি বছরই বড় অংশ ফেরত আসছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন খাতে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। পর্যটন খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কচ্ছপগতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। এছাড়া পর্যটনকেন্দ্রগুলোর দুর্বল অবকাঠামো ও অপর্যাপ্ত বিনিয়োগের সঙ্গে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এসব কারণে অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাত বিকশিত হতে পারছে না। বিশেষ করে, দেশের বেসরকারি পর্যটন খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করলেও সরকারের হোটেল মোটেল, পর্যটন কেন্দ্রগুলো লোকসান দিচ্ছে।

জানতে চাইলে প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব ও জার্নি প্লাসের প্রধান নির্বাহী তৌফিক রহমান ইত্তেফাককে বলেন, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিদেশি পর্যটক কমে গেছে। এর পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সেই খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যাওয়া। অথচ যেসব দেশকে পর্যটনপ্রিয় দেশ ভাবা হয়, এমন ২০টি দেশ বাংলাদেশকে তালিকাভুক্ত করেছে। যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, স্পেন, নেদারল্যান্ডসসহ আরো অনেক দেশ তাদের ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে।

তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা ওঠানোর জন্য এখানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, মিনিস্ট্রি অব সিভিল এভিয়েশন ট্যুরিজম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হাইকমিশন মিলে একটি যৌথ পরিকল্পনা করা দরকার।

পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় পর্যটনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটন খাতকে আরো উন্নত করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন, ই-ভিসা চালু করা, পর্যটন এলাকার রাস্তাঘাট-অবকাঠামো উন্নয়ন বেং বিদেশি পর্যটকদের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। এ ছাড়া বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণগুলো সেভাবে তুলে ধরতে হবে।

জানতে চাইলে দেশের পর্যটন খাতের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিওএবি) সভাপতি রাফিউজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, দেশীয় পর্যটনে বাধাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। পর্যটন বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ট্যুরিজম বোর্ড, পর্যটন করপোরেশন কাজ করলেই হবে না, সবাইকে এই খাতের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন দেশের ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি প্রত্যাহারেও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যটন সম্পর্কে আমরা সরকারের কাছে বারবার বলে আসছি, ভ্রমণ সতর্কতা তুলে নেওয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য। অনেক দেশ ই-ভিসা চালু করেছে, কিন্তু আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। কিছু দেশকে অন অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া থাকলেও বিমানবন্দরে পর্যটকদের বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। এটা বিবেচনা করতে হবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) এর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের পরিস্থিতি তেমন খারাপ নয়, তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। ইতিমধ্যে আমাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিদেশি পর্যটক কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে প্রকৃত পর্যটকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশ ভ্রমণে পর্যটকরা যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে না পড়েন।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) এর সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মো. তোহা চৌধুরী বলেন, অভ্যন্তরীণ পর্যটনের ক্ষেত্রে বাধা অনেক। অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত প্রসঙ্গে বলতে গেলে সেন্টমার্টিনের কথাই বলি, পরিবেশের দোহাই দিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছিল। এখন আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে দ্বার। কিন্তু যেসব শর্ত দেওয়া হচ্ছে তা বাস্তবসম্মত নয়। এখানে অধিকাংশ পর্যটক যায় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে। ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার জন্য কে যাবে? সিদ্ধান্তটা পুনর্বিবেচনা করা দরকার।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে দেশে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৬৬৫ জন, ২০১৮ সালে ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ বিদেশি নাগরিক দেশে আসেন, এই সংখ্যা ছয় লাখ ২১ হাজার ১৩১। করোনার সময় ২০২০ সালে এসেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন, ২০২১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন, আর ২০২২ সালে দেড় লাখ বিদেশি আসেন। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার। গেল বছরের হিসাব এখনো আসেনি পর্যটন বোর্ডের কাছে। এসব বিদেশির কতজন ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে এবং কতজন প্রকৃত পর্যটনের উদ্দেশ্যে এসেছেন সেই তথ্য দিতে পারেনি বিটিবি।

বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ

বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপিত হচ্ছে। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘টেকসই উন্নয়নে পর্যটন’।

উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পর্যটন অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। পর্যটনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি ও মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় সমঝোতা ও বন্ধুত্ব। যুদ্ধের অনুপস্থিতি শুধু শান্তি নয়; সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে পর্যটনের ভূমিকা অপার।

দিবসটি উপলক্ষে এক বানীতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পর্যটন খাতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ। এই শিল্পের যথাযথ বিকাশ নিশ্চিতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এ শিল্পের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্বব্যাপী পর্যটনের প্রচার ও প্রসারে ১৯৮০ সাল থেকে জাতিসংঘের পর্যটন বিষয়ক সংস্থা ঘোষিত এ দিবসটি সকল সদস্য দেশে যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপন করে আসছে।

বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপন করতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, অধীন দপ্তর-সংস্থা, ট্যুরিস্ট পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *