দেশ রূপান্তর
খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরী ‘ধর্ষণের’ অভিযোগ ওঠার জেরে চার দিন থেকে সেখানে যে অবরোধ চলছিল, তা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে জুম্ম ছাত্র-জনতা। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টায় তাদের ফেসবুক পেজে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে, দুর্গাপূজার প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং প্রশাসনের তরফে আট দফা দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান অবরোধ কর্মসূচি ৫ অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত করা হলো।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গুইমারায় সংঘটিত ঘটনার তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও আমরা অবহিত হয়েছি।
জুম্ম ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এদিন দুপুরে গুইমারায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ির ডিসি এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার, এসপি আরেফিন জুয়েল, গুইমারার ইউএনও আইরিন আক্তার ও গুইমারা থানার ওসি মো. এনামুল হক চৌধুরী।
এদিকে এখনো খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়ার কথা জানান।
সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি ও গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ঘটনার উসকানি এবং পাহাড়ি নারী ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করেছেন। তারা গতকাল পৃথক ব্রিফিংকালে এসব অভিযোগ করেন।
গতকাল চতুর্থ দিনের মতো জেলার ভেতরে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধ অব্যাহত ছিল। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা বহাল ছিল, যার ফলে সারা দিনই শহরে পরিস্থিতি ছিল থমথমে।
গত রবিবার গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার ও আশপাশের এলাকায় সহিংসতায় তিনজন পাহাড়ি নিহত এবং প্রায় ৩০ জন আহত হয়। বাজার, দোকানপাট, বাড়িঘর ও অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এ উত্তেজনার সূত্রপাত গত বুধবার রাতে এক মারমা কিশোরীকে ‘অচেতন অবস্থায়’ ক্ষেত থেকে উদ্ধারের ঘটনা কেন্দ্র করে। পরদিন রাতে কিশোরীর বাবা ধর্ষণের অভিযোগে সদর থানায় মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় একজনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ধর্ষণের প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে সহিংস রূপ নেয়।
গতকাল সকালে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের সেনাবাহিনী কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও এর অঙ্গসংগঠনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী সবসময় এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। নারী, শিক্ষার্থী ও শিশুদের সামনে ঠেলে দিয়ে সহিংসতা সৃষ্টি কোনো ইতিবাচক বার্তা বহন করে না।’
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনকালে বলেন, ‘খাগড়াছড়ির সহিংস ঘটনা শারদীয় দুর্গাপূজাকে বিঘিœত করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছে। কিছু সন্ত্রাসী পূজা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হতে বাধা দিতে চেয়েছিল, তবে তাদের প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হয়েছে।’ তিনি জানান, ধর্ষণ ও সহিংসতার ঘটনায় জড়িত কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
৩৬ নাগরিকের বিবৃতি : খাগড়াছড়ির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের ৩৬ বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে বিশিষ্ট নাগরিকরা পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে কিশোরী ধর্ষণের সব আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান; সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা; ভিডিও ফুটেজে চিহ্নিত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা এবং নিহত তিন পাহাড়িদের পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা; ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরের মালিকদের ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তা দেওয়া।
বিবৃতিতে সই করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, ইফতেখারুজ্জামান, রাশেদা কে চৌধূরী, জেড আই খান পান্না, সারা হোসেন, শিরীন পারভীন হক, পাভেল পার্থ, রেহেনুমা আহমেদ প্রমুখ।
