Google Alert – সশস্ত্র
ছবির উৎস, Bettmann Archive/Getty Images
কোকুরা শহর এখন আর নেই।
কারণ ১৯৬৩ সালে কোকুরাসহ আরও চারটি শহর মিলিয়ে গঠিত হয় কিতাকিউশু। জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত শহরটি বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ মানুষের আবাসস্থল।
তারপরও কোকুরা নামটি এখনো জাপানের সাধারণ মানুষের মনে বেঁচে আছে। কারণ এ শহরের বিলুপ্তি হতে পারত আরও কম আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং অনেক বেশি মর্মান্তিকভাবে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে যে কয়টি শহরকে পারমাণবিক বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিল, তার একটি ছিল কোকুরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে অলৌকিকভাবে দুইবার প্রায় নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায় শহরটি।
নয়ই অগাস্ট পারমানবিক বোমা হামলা থেকে মাত্র কয়েক মিনিট দূরে ছিল কোকুরা – ঠিক যেমনটা তার তিনদিন আগে দেখা গিয়েছিল হিরোমশিমায়।
কিন্তু নানা কারণে মার্কিন বিমান বাহিনী শেষ পর্যন্ত কোকুরার বদলে নাগাসাকিকে লক্ষ্যবস্তু করে।
ধারণা করা হয়, সেই বোমা হামলায় হিরোশিমায় এক লাখ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে ৭৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
এবং পরবর্তী বছরগুলোতে আরও বহু হাজার মানুষকে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব ভোগ করতে হয়েছিল।
কালক্রমে “কোকুরার ভাগ্য” জাপানি ভাষায় এমন এক প্রবাদে পরিণত হয়েছে, যা দিয়ে ভয়াবহ পরিণতি থেকে ভাগ্যের জােরে রক্ষা পাওয়া বোঝায়।
কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল কোকুরায়?
ছবির উৎস, AFP via Getty Images
আকাশে মেঘ আর ধোঁয়া
১৯৪৫ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বোমা হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্তৃপক্ষ কারখানা ও সামরিক ঘাঁটির মতো লক্ষ্যবস্তু থাকা জাপানের ১২টি শহর বাছাই করে।
অগ্রাধিকারের তালিকায় হিরোশিমার পরেই ছিল কোকুরা।
এটি ছিল অস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্র এবং জাপানি সামরিক বাহিনীর বিশাল অস্ত্রাগারগুলোর একটি।
ছয়ই অগাস্ট যদি কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমায় বোমা ফেলতে না পারত, তবে কোকুরাই হতো পারমাণবিক বোমার প্রথম লক্ষ্যবস্তু।
তিন দিন পর নয়ই অগাস্ট ভোরে বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো কোকুরার দিকে উড়ে যায়।
সেগুলোর মধ্যে থাকা বক্সকার বহন করছিল প্লুটোনিয়াম বোমা “ফ্যাট ম্যান”, যা ছিল হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত ইউরেনিয়াম বোমার চেয়েও শক্তিশালী।
কিন্তু ঘটনার দিন সকালে কোকুরা ছিল ঘন মেঘে আচ্ছন্ন। পার্শ্ববর্তী ইয়াওয়াটায় আগের দিন বোমা হামলায় সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়ায় আকাশ আরও অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
ইতিহাসবিদের দাবি, কোকুরার কারখানাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে কয়লা পুড়িয়ে শহরের ওপর ধোঁয়ার পর্দা তৈরি করেছিল- কারণ সেসময় পুরো জাপানজুড়ে বিমান হামলা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
মার্কিন সামরিক নথি এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক উইলিয়াম লরেন্স (যিনি নয়ই অগাস্টের অভিযানে অংশ নেওয়া একটি বিমানে ছিলেন), তার প্রতিবেদনে বলা হয়, বি-২৯ বিমানগুলো কোকুরার আকাশে তিনবার চক্কর দেয়।
আদেশ ছিল কেবল লক্ষ্যবস্তু দৃশ্যমান হলেই বোমা ফেলা যাবে, যাতে এর বিধ্বংসী শক্তি সবচেয়ে বেশি হয়।
সমস্যা হলো, এর আগেই কোকুরার স্থল প্রতিরক্ষা বাহিনী বিমানগুলোকে শনাক্ত করে এবং গুলি চালানো শুরু করে।
তখনই বক্সকারের পাইলট মেজর চার্লস সুইনি নাগাসাকির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ অপেক্ষা করার সময় বিমানের মূল্যবান জ্বালানিও পুড়ছিল।
এভাবেই কোকুরা দ্বিতীয়বারের মতো রক্ষা পায়।
ছবির উৎস, Bettmann Archive/Getty Images
রাজধানী নয়
১৯৪৫ সালের মার্চ মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানগুলো জাপানে লাগাতার হামলা চালাচ্ছিল, আগুন লাগানো বোমা ব্যবহার করে শহরগুলোকে একের পর এক পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
নয়ই মার্চ টোকিওতে মাত্র এক রাতের হামলায় প্রায় ৮৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন।
কিন্তু অগাস্টে যখন বি-২৯ বিমানগুলো কোকুরার আকাশে পৌঁছায়, তখন শহরটি কার্যত অক্ষত ছিল।
অন্যান্য পারমাণবিক বোমার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর মতো এটিও অগ্নিসংযোগকারী বোমা হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল এই শহরগুলোকে যতটা সম্ভব অক্ষত রাখা, যাতে তারা পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি ভালোভাবে বুঝতে পারে।
প্রাথমিক তালিকায় নাগাসাকি না থাকলেও পরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী হ্যারি স্টিমসনের উদ্যোগে এটি তালিকায় যুক্ত হয়।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে তিনি রাজি করান এই বলে যে, জাপানের এক সময়কার রাজধানী কিয়োটোকে ধ্বংস করে দিলে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে টোকিও ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সমঝোতা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে।
তবে, মার্কিন ইতিহাসবিদরা পরবর্তী সময়ে দাবি করেন, কিয়োটোকে রক্ষা করার পেছনে স্টিমসনের ব্যক্তিগত কারণও ছিল।
তিনি এর আগে একাধিকবার জাপান সফর করেছিলেন এবং ধারণা করা হয়, নিজের মধুচন্দ্রিমাও তিনি কাটিয়েছিলেন এ শহরেই।
ছবির উৎস, Kitakyushu City handout
স্বস্তি আর বেদনা
১৯৪৫ সালের ১৫ই অগাস্ট সম্রাট হিরোহিতো জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন।
কোকুরা—যা এখন কিতাকিউশু—ধ্বংসের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেলেও সেসময় চরম উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা পায়নি।
যখন জানা গেল নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমাটি মূলত এই শহরের জন্যই নির্ধারিত ছিল, তখন স্বস্তির সঙ্গে মিশে যায় বেদনা ও সহানুভূতি।
কিতাকিউশুতে রয়েছে নাগাসাকি পারমাণবিক বোমা স্মৃতিস্তম্ভ, যা নির্মিত হয়েছে প্রাক্তন অস্ত্রাগারের জায়গায় তৈরি এক উদ্যানের মধ্যে।
স্মৃতিস্তম্ভটিতে এই শহরের অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়া এবং নাগাসাকির বিপর্যয়ের কথা উভয়ই উল্লেখ আছে।
১৯৭৩ সাল থেকে এখানে প্রতি বছরের নয়ই অগাস্ট স্মরণ অনুষ্ঠান আয়ােজিত হয়ে আসছে।
২০২২ সালে কিতাকিউশু সিটি মিউজিয়াম অব পিস (শান্তি জাদুঘর) জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
গত কয়েক দশকে দুই শহরের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এবং তাদের জড়িয়ে থাকা ভাগ্যের কথা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত।
তবে কিতাকিউশুও বহু পরিবর্তনের সাক্ষী।
জাপানের পুনর্গঠনের সময়ে এই শিল্পনগরী এতটাই দূষিত হয়ে পড়ে যে এর দোকাই উপসাগরের পানি প্রায় প্রাণহীন হয়ে পড়ে।
বর্তমানে নবায়নযোগ্য প্রযুক্তিতে বহুদিনের বিনিয়োগের ফলে এটি এশিয়ার অন্যতম সবুজ শহর হিসেবে স্বীকৃত – যা অতীতকে কখনো ভুলবে না, কিন্তু দৃঢ়ভাবে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেছে।
