হিল ভয়েস
জীবন চাকমা
প্রয়াত প্রখ্যাত লেখক আক্তারুজ্জামান আমাদের প্রিয় ইলিয়াস ভাই একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন আমরা কি সত্যই বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাস করি কিনা। উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই আবার বলেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে তার তাতে কোন আপত্তি নেই। তবে কিনা একটা অনুরোধ রোমান হরফ ব্যবহার না করে তাদের বাংলা হরফ ব্যবহার করতে হবে আমাদের ভাষার উন্নয়নের জন্য। কারণ দীর্ঘদিন বাংলার সাথে যে সম্পর্ক তার ভালো অনেক দিকও রয়েছে। উনি তখনো ঢাকা কলেজে পড়াতেন। মনে মনে বলেছিলাম, ইলিয়াস ভাই সত্যি বলতে কি স্বাধীনতা কে না চায়। তবে সেই স্বাধীনতা সার্বভৌম নয় হয়তো। সেই স্বাধীনতা হলো অত্যাচার থেকে, ভূমি জবরদখল থেকে। সেই স্বাধীনতা জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা থেকে। বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বাস্তবতা নেই বলেই আমরা আপাততঃ বিচ্ছিন্নতার প্রত্যাশা করি না।
ভাবতে অবাক লাগে প্রসিত বাবুরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য মরনপণ লড়াইয়ে সদা ব্যস্ত। তাদের লড়াইয়ে মূখ্য শত্রু এখন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন পেতে হলে প্রথম আঘাত করতে হবে জেএসএস এর উপর এই হল তাদের রণনীতি। তাই ভাবতে অবাক লাগে কী হতে কী হলো। কিন্তু ভালো কথা পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন কেন, স্বাধীনতাই বা কে না চায়। শক্তি, সামর্থ্য এবং সেই বাস্তবতা নেই বলে তো আজ এই আঞ্চলিক পরিষদ। তাছাড়া এই চুক্তির জন্য প্রসিত বাবুরাও যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী তা কি তারা আদৌ ভেবেছে? সে কথায় পরে আসব। তার আগে বলা দরকার আঞ্চলিক পরিষদ বা আধাআধি স্বায়ত্ত্বশাসন আমরাও চাই না। কথিত শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ জেএসএসও বলুক তারা এই আঞ্চলিক পরিষদ মনেপ্রাণে চেয়েছে কিনা। সাধারণ জনগণও নিশ্চয়ই চায়নি। কিন্তু তারপরও শান্তিচুক্তি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এখনকার সময়ের জন্য এটাই বাস্তবতা। প্রসিত বাবুরা কি ধরনের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন চায়- সেটা আদৌ পরিষ্কার নয়। তিনি কিন্তু জেএসএস এর পাঁচদফার সমর্থক। কেবল সমর্থক বললেও কম বলা হয়। জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জেএসএস এর সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেয়া তো তার জীবনের একমাত্র প্রতিজ্ঞা। আমরা যখন শান্তিবাহিনীতে না যাওয়ার কথা বলতাম তখন তারা কজন অবাক হয়ে যেতো। মনে হতো এটা কী রকম একটা অসম্ভব কথা বলে ফেললাম। শান্তিবাহিনী তথা সশস্ত্র সংগ্রামে নিজেকে নিবেদিত রাখাটাই তখনকার সময়ে একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। সে যাই হোক, মনে করতে হবে তার পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন মানে জেএসএস এর পাঁচদফা। নাকি তার অন্য কোন ফর্মূলা আছে? তাহলে সেটাই বা কী? সেটা যদি নতুন কিছু হয়ে থাকে তাও আমাদের জানা দরকার। তার বাস্তবতা কী তা জানলেও তো ক্ষতি নেই।
প্রসিত বাবুরা হয়তো তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি। আর তা হল – (১) তাদের এই আন্দোলন কেন? (২) তাদের এই আন্দোলন কার বিরুদ্ধে? এবং (৩) তাদের এই আন্দোলন কাদের নিয়ে? উত্তরও বলে দেওয়া দরকার যদি না তারা জানেন। (১) এই আন্দোলন জুম্ম জনগণের অধিকারের (অধিকারের মাত্রা অনির্ধারিত – শান্তিচুক্তির আঞ্চলিক পরিষদও হতে পারে, আবার ৫ দফাও হতে পারে। এমনকি স্বাধীনতাও)। (২) এই আন্দোলন বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে এবং (৩) এই আন্দোলন অবশ্যই জুম্ম জনগণকে নিয়ে। উত্তর যদি তাই হয়, তবে বলতে হবে প্রসিত বাবুরা আপনারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। প্রথমতঃ বলতে হয় ৮৯ সালে যখন জনবিরোধী স্থানীয় সরকার পরিষদ হচ্ছিল সেই সময়ে ৪ঠা মে লংগদুর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। যা আজ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ নামে দ্বিখন্ডিত। তখন জেলা পরিষদ বাতিলের আন্দোলনে আপামর জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছিল। বলা যেতে পারে তখন কেবলমাত্র ৯১ জন তখনকার সময়ের চামচা ছাড়া ইব্রাহিমের মত সেনাকর্তার সৃষ্ট ৯ দফা রূপরেখাকেও অন্য কেউ সমর্থন করেনি, বিশ্বাস করেনি। অথচ ভাবতে অবাক লাগে আমরা তা বাতিল করতে পারিনি। ’৯০ এর গণ আন্দোলনের পর সর্বসম্মত সরকার প্রধান আজকের প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন আহম্মদ রাঙ্গামাটি গিয়ে সবাইকে রীতিমত অবাক করে অপ্রত্যাশিতভাবে সেই গণবিরোধী জেলা পরিষদ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে আসেন। শতকরা ৯৯ এরও বেশি লোকের প্রচন্ড বিরোধীতার মুখেও দিব্যি টিকে গেছে সেদিনের জেলা পরিষদ। আর আজকে কম করে হলেও ৯৯ শতাংশ মানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থনে গড়ে উঠা আঞ্চলিক পরিষদ ভেঙে দেওয়া এবং জেএসএস খতম করার আন্দোলন কেবল হাস্যকরই নয়, রীতিমত বাড়াবাড়িও।
ধান ভানতে শিবের গীত না করে আসল কথায় আসা যাক। বলছিলাম প্রসিত বাবুদের আন্দোলন কেন। নিশ্চয়ই অধিকারের জন্য। সেই অধিকার কথিত পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনও হতে পারে যদিও আজো জানি না সেই পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের মানেটা কী। মাত্রাও বা কী তার। তবে এই কথা ধ্রুব সত্য যে, জুম্ম জনগণের আন্দোলন করার যে মাত্রায় ত্যাগের মানসিকতা সেই মাত্রা দিয়ে এই আঞ্চলিক পরিষদ পাওয়া যায় মাত্র। এর বেশি আশা করা বৃথা। অপর দিকে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও যেহেতু বাংলাদেশ সরকার তাই এই সরকার এইটুকুই দিতে পারে। এর বেশি নয়। অর্থাৎ আঞ্চলিক পরিষদ পর্যন্ত। প্রসিত বাবুরা বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির কাছে যদি আঞ্চলিক পরিষদের চেয়েও বেশি কিছু আশা করেন তাহলে আমাদের কিছুই করার নেই। আর আওয়ামী লীগের থেকে তো আঞ্চলিক পরিষদ পাওয়াটাও যথেষ্ট। তবে প্রসিত বাবুরা নাকি গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট নাকি যেন একটা আছে তার থেকে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন কামনা করেন। ভাবতে রীতিমত হাসি পায়। অবশ্য সেই দুরাশা প্রসিত বাবুরা করবে না বলেই বিশ্বাস।
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর যেহেতু জুম্ম জনগণ, কাজেই সেই জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ তো প্রসিত বাবুরা নিজেরাই। তাহলে আন্দোলন করে দেখুন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে পড়ে। ভাল কিছু করতে পারুন তার শুভ কামনা করি। পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন বাদই দিলাম। আঞ্চলিক পরিষদের থেকে কিছু বেশি হলেও তথাস্ত। কিন্তু পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের নামে ইদানিং যা করছেন তা আর যাই হোক ভাল বা নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে না। কেবল গোয়াতুর্মী দিয়ে নেতার কর্তৃত্ব বা ব্যক্তিত্ব রক্ষা করা যায় না। এযাবত তার বিশুদ্ধ নেতৃত্ব কী দিতে পেরেছে? ছাত্র জীবনে প্রসিত যা করেছে তা হলো বিভেদ, ভাঙন, বিক্ষুদ্ধ গোষ্ঠির জন্ম দেয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ দ্বিধাবিভক্ত করার ক্ষেত্রে প্রসিত খীসা দায়ী। পরবর্তীতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদসহ গণ পরিষদ এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশন দুই টুকরো হওয়ার পেছনেও প্রসিত খীসা নির্মমভাবে দায়ী। উনি থাকলে কথিত ইউপিডিএফও অনিবার্য খন্ডিত হবেই হবে। তার কথায় সত্য পৃথিবীতে একটাই। দুটো সত্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এবং তিনি যা ভাবেন, করেন একান্তই জুম্ম জনগণের জন্যই। এই সত্যের বিপরীতে সবই দালালী, স্বার্থবাদিতা ও মিথ্যা।
অতএব তার দেশপ্রেম, জাতপ্রেমই সাচ্চা। অন্যদের দেশপ্রেম-জাতপ্রেম থাকলেও নিখাদ নয়। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগ্রাম করতেই হবে। সে যদি খুনের রাজনীতিও হয়। সমাজের কোন অঙ্গ পচাঁ থাকলে তার সমূলে উচ্ছেদ না করে উপায় নেই। যদিও তার মুখে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। সেটা হলো মাথায় রোগ হলে তো আর মাথা কেটে বাদ দেয়া যায় না। জুম্ম সমাজে এক সময় ছিল গণ দুশমন জেলা পরিষদের চামচারা আমাদের জাতীয় শত্রু। তাই তাদের বিরুদ্ধে গণ সচেতনতা সৃষ্টি করতে তাদের গায়ে মলমূত্র, থুথু, পচাঁ ডিম ছুড়ে মারার গোপন সার্কুলার দিয়েছিলেন প্রসিত বাবু। কিন্তু এসবই ছিল মূল কর্মসূচী থেকে জনগণকে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের অপচেষ্টা মাত্র। এযাবত প্রসিত নেতৃত্ব যা দিয়েছে তা হল মূল কর্মসূচী বাদ দিয়ে দালাল খতম করার চারু মজুমদারের লাইন। ’৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মুল জাতীয় কমিটির ন্যায় প্রিয় কুমারকে গণ আদালতে বিচার করা থেকে শুরু করে চোর ধরে মাথা ন্যাড়া করে জুতোর মালা পরিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়ে শাস্তি দেওয়ার মত রোমান্টিক শুদ্ধি আভিযানের কর্মসূচীতে নিজে প্রত্যক্ষভাবে ছিলেন প্রসিত বাবুরা। আজো তাই দেখছি। দালালি করা অবশ্যই ক্ষতিকর সামগ্রিক স্বার্থে। তবে দালালী না করেও প্রসিত বাবুরা যা করছেন তা কয়েক হাজার গুণ ভয়ানক। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রথম যেটা তারা চায় তা হচ্ছে জেএসএসকে নির্মূল করা। এটা রণকৌশল হতে পারে না। তাহলে কি এটা রণনীতি? যদি তাই হয় তাহলে এটা ধ্বংসের। এ নীতি না বদলালে সার্বিকভাবে পরিণতি খারাপ। কারণ জেএসএস আজ নিরস্ত্র হলেও তার উপর আঘাত আসলে তা থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা করতে বাধ্য। প্রয়োজনে মরিয়া হয়েও জেএসএস প্রতিরক্ষার্থে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবে। সাধারণ মানুষের সমর্থন না পেলেও। কারণ মরতে কে চায়? সুতরাং যে জেএসএস এর আন্দোলনের গর্ভে আপনাদের জন্ম, যে জেএসএস এর নুনও খেয়েছেন বিস্তর সেই জেএসএস এর গুণ না হয় নাই বা গাইলেন অন্ততঃ তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা কত বড় বেঈমানী তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। এর পরিনতিও কখনো শুভ হতেই পারে না। এ কোন সেলুকাস! নেমক হারাম আর কাকে বলে।
আজকের আঞ্চলিক পরিষদ বা কথিত শান্তি চুক্তির জন্য কেবল জেএসএস নয় প্রসিত বাবুরাও দায়ী। দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা আর কী। আশি দশকের গোড়া থেকেই প্রসিত বাবুদের জেএসএস নৈতিক ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়েছে একথা কারোর অজানা নয়। বাইরে ছাত্র আন্দোলন দাঁড় করানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জেএসএস একান্তভাবে নিবেদিত ছিল। এই নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে আজকের পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের আন্দোলন। এমন এক সময় ছিল যখন প্রসিত বাবুদের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে অনেক কিছুরই সামাল দিয়েছে পার্টি। এমন কি প্রসিত বাবুদের নিরাপত্তার জন্য গুন্ডা ভাড়া করার টাকাও দিতে হয়েছে জেএসএসকেই। এসব ভাবতে লজ্জা হয় বৈকি। একেই বলে দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা। মূল কথা হল জেএসএস এর শুভেচ্ছা নিয়ে, তার কাঁধে ভর করে একটা বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তোলার লালিত স্বপ্ন প্রসিত বাবুকে বরাবরই আচ্ছন্ন করে রাখত।
কথায় কথায় আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার মিথ্যা বুলি, পার্টির প্রতি তার মিথ্যা আনুগত্য এবং পার্টির শুভেচ্ছা কাজে লাগিয়ে ছাত্রদের মাঝে নিজের অবস্থান পোক্ত করার চেষ্টা করে গেছে নীরবে নিভৃতে। তবে স্কুল জীবনেই গড়ে তুলেছিল আদর্শ যুব সংঘ। পরবর্তী পর্যায়ে গড়ে তুলে পার্বত্য যুব ও ছাত্র সংহতি সংঘ নামের গোপন আঁখড়া। জেএসএস এর আর্থিক সহায়তায় এ আঁখড়ার জম্ম হলেও জেএসএস কোন দিন জানতে পারেনি এর গোপন কর্মসূচী। জেএসএস এর চোখে ধূলো দিয়ে একান্ত গোপনে গড়ে তোলা এই সংঘ ক্রমে ক্রমে কিছু আত্মনিবেদিত ছাত্র কর্মীর জন্ম দেয় যারা পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। এদের অনেকেই আজ আর প্রসিত বাবুর সাথে নেই। সাথে না থাকার একমাত্র কারণ প্রসিত বাবুকে মানতে না পারা নয়। বিভিন্ন কারণ আছে। প্রসিত অবশ্য প্রায়ই বলত সময় এলে গাছে অনেক ফুল ধরে কিন্তু সব ফুল ফলে পরিণত হয়না। খুবই সত্য কথা। তবে এখন দেখি সব ফুল ফলে পরিণত না হয় সত্য কিন্তু যেসব ফল হয়ও তার মধ্যে আবার পোকাক্রান্ত হলে যে কি ভয়ংকর হতে পারে তার জাজ্জ্বল্য উদাহরণ প্রসিত বাবু নিজেই। আর বেশি পেকে গেলেও মহাবিপদ। অর্থাৎ জাতপ্রেমের নেশাটা যদি মাতাল করে দেয় তার পরিণতিও মারাত্মক। প্রসিত বাবুরা এখন দুটোর যেকোন একটা। হয় আধাপাকা হয়ে রোগাক্রান্ত বা অতি ঝুনো ফলে পরিণত হয়ে পঁচে বসে আছেন। দুটোই আমাদের সমাজে এখন ভয়ানক পচন ধরাচ্ছে। আর না হলে খুনোখুনির মরণ খেলায় মেতে উঠবেই বা কেন তারা?
মূল কথায় ফিরে আসা যাক। পার্টি শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হওয়ার পেছনে প্রসিত বাবুরাও দায়ী বলেছিলাম। কিন্তু কেন? সম্ভবতঃ পার্টি পাঁচটি মৌলিক কারণে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে প্রথম তিনটি অভ্যন্তরীণ। পরের দুটি বাহ্যিক। (১) দলীয় বাস্তবতা। (২) সাধারণভাবে জুম্ম জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অবসাদগ্রস্ততা। (৩) ছাত্র-যুবকদের আন্ডারগ্রাউন্ডে সংগ্রাম করার অনীহা এবং রাজপথের আন্দোলনে মোহগ্রস্ততা। (৪) দেশের রাজনৈতিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি এবং (৫) প্রতিবেশী দেশ ভারত ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি। এই লিডিং পাঁচটি কারণের মধ্যে প্রথম তিনটিই এখানে আলোচ্য। আজ হোক কাল হোক সশস্ত্র সংগ্রামে নিজেকে সমর্পিত করার রক্তশপথ নিলেও প্রসিত বাবু নিজে কখনো জেএসএস এর সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়ার দৃঢ়তা দেখায়নি। তার সশস্ত্র সংগ্রাম কিভাবে, কার নেতৃত্বে সেকথা কোনো কালেই খোলাখুলি বলেননি প্রসিত বাবু। কিন্তু দুর্ভাগ্য জেএসএস এর স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল এই ক্ষুদে উদীয়মান নেতা একদিন অবশ্যই সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেবে। তখনো তার উচ্চাভিলাষী চেহারাটা প্রকাশ পায়নি। জেএসএসই বা বলি কেন? সাধারণ ছাত্র-যুবক কর্মীরাও মনে করত অন্য কেউ না গেলেও প্রসিত বাবু জেএসএস-এ যোগ দেবেই। ’৯৩ সাল থেকে জেএসএস নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে পার্টিতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানালে প্রসিত বাবু বরাবরই এড়িয়ে গেছেন। তার মতিগতি দেখে জেএসএস অবশেষে পার্টিতে অন্তর্ভূক্ত (পার্টিতে কেবল নাম লিখিয়ে) হয়ে বাইরে কাজ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানায়। প্রসিত বাবু তাও গোপনীয়তার অজুহাত দেখিয়ে সুকৌশলে এড়িয়ে যান। ক্রমে প্রসিত বাবু নিশ্চয় বুঝতে পারেন যে জেএসএস তখন ঠিক কী চাইছিল। এরপর থেকে তালবাহানা শুরু। পার্টির কর্মসূচীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কাজ শুরু করতে থাকেন। গ্রামে গ্রামে তার মুরুব্বিয়ানা বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ বিচার-আচার থেকে শুরু করে ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আদলে তথাকথিত গণআদালত পর্যন্ত বসান প্রসিত বাবু নিজে।
শান্তি আলোচনা চলাকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যখন পার্টি দালালদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টায় জড়িত তখন প্রসিত বাবুরা দালালবিরোধী কর্মসুচী দিয়ে জেএসএস এর প্রতি দৃষ্টতা দেখাতে থাকে। ঘন ঘন অবরোধ, হরতাল ইত্যাদি কর্মসুচী দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টির পাঁয়তারা করতে থাকে। প্রিয় কুমারের মত ভিলেজ পলিটিশিয়ানের সাথে জেএসএস নেতার সাক্ষাৎ হওয়ার নিতান্তই মামূলী ঘটনাকে কেন্দ্র করে পার্টির সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি করে। পার্টির সাথে মতভিন্নতা দেখিয়ে পার্টির সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর সেই যে অপচেষ্টা এক পর্যায়ে এসে যখন রীতিমত শত্রুতায় পরিণত করে প্রসিত পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের রঙিন ফানুস উড়িয়ে জনগণকে নূতন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন নয়, স্বাধীনতার মোহে থাকলেও কারো কোনো ক্ষতি বা আপত্তি নেই। আপত্তিটা তখনই যখন উনারা পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠায় জেএসএসকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে আঘাত আর হত্যার লীলা খেলায় মাতোয়ারা। দোহাই এই খেলা বন্ধ করুন প্রসিত বাবু। আপনার রাজনৈতিক জীবনে ক্যারিয়ারের জন্যেও তা মঙ্গল। কিছু জেএসএস বিরোধী মানুষকে নিয়ে খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ আর জেএসএস খতম করার মাধ্যমে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন অর্জনের দিবাস্বপ্ন বাস্তবের মুখ তো দেখবেনই না বরং এই আন্দোলনে আপামর জনগণকেও পাওয়া যাবে না।
জেএসএস এর অনেক ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনারা তো গোড়াতেই ভুল করে বসে আছেন। শান্তি চুক্তি মানেন না ভালো কথা। আমরাও মানি না। কিন্তু জেলা পরিষদের সময়কার বিরোধিতার মত এই চুক্তি এবং জেএসএস বিরোধিতা করার বাস্তবতা এখন নেই। শান্তি চুক্তির সমর্থন না করেও জুম্ম জনগণের অধিকতর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত রাখা যায়। জেএসএস বা শান্তি চুক্তি হয় আমলই দিলেন না কিন্তু তাতেও তো পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন-টাসন যাই বলুন সেই আন্দোলন জিঁইয়ে রাখা যেত। জনগণকে আজ হোক কাল হোক পাওয়া যেত। কারণ শান্তি চূক্তিতে আদৌ কারোর শান্তি নেই। চার লক্ষাধিক অনুপ্রবেশকারী আর শত সহস্র সেনাবাহিনীকে জায়গা দিয়ে কারোর শান্তিতে থাকার উপায় নেই। একথা জেএসএস চুক্তির আগেও বুঝতে পেরেছে পরেও তাই। আর এ কারণেই পার্টি তার আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। শক্তি সামর্থ্য যা আছে তা দিয়ে সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রসিত খীসার বাবা অনন্ত বিহারী খীসারও এখন মরণকালে হরিনাম। এই জ্ঞানপাপী ভদ্রলোকটি বলতেন, জেএসএস মৃত ছেলে কোলে নিয়ে কান্নাকাটি করছে। অর্থাৎ জেএসএস এর আন্দোলন বৃথা। অথচ ভাবতে অবাক লাগে ছেলের সাথে উনিও ইদানিং পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলনে সদা তৎপর। তা তিনি এখন কী নিয়ে কান্নাকাটি করতে বসলেন। মরা ছেলে নাকি মরে ভুত হয়ে যাওয়া ছেলে নিয়ে। কোনটা?
(চলবে..)
*লেখাটি পূর্ব প্রকাশিত