Google Alert – সেনাবাহিনী
ছবির উৎস, Getty Images
ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর দশই মে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও দুই দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধ এখনো চলছে।
দুই প্রতিবেশি দেশই প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য এবং একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের দেশের অবস্থানের কথা তুলে ধরার চেষ্টাও জারি আছে।
ইরান সফরে গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ জানিয়েছেন, পাকিস্তান শান্তির বিষয়ে কথা বলতে প্রস্তুত এবং তারা জল, বাণিজ্য ও সন্ত্রাসের মোকাবিলার বিষয়ে আলোচনায় বসতে পারে যদি ভারত গুরুত্ব দেয়।
এরই মাঝে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আবার পাল্টাপাল্টি বিবৃতিতে জড়িয়েছে দুই দেশ।
ভারত আরও একবার নিজেদের পক্ষ স্পষ্ট করে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হলে তা ‘সন্ত্রাসবাদ’ নির্মূল করা এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েই হবে।
অন্যদিকে, ইসলামাবাদের বক্তব্য–– পাকিস্তান ‘কখনোই কাশ্মীর ছেড়ে যাবে না’।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একটা অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের তিনি ‘পরিবারের অংশ’ বলেই মনে করেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দারা একসময় “নিজের ইচ্ছায় ফিরে (ভারতে) ফিরে আসবেন।”
পরে সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিং-এ কাশ্মীর ইস্যুতে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে বলতে শোনা যায়, দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হলে তা “দ্বিপাক্ষিকভাবেই হবে এবং এই বিষয়ের ওপর হবে যে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর তারা (পাকিস্তান) কবে খালি করবে।”
এরপর ইসলামাবাদও পাল্টা জবাব দেয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির জানিয়ে দেন, কাশ্মীর নিয়ে কোনো সমঝোতা সম্ভব না।
পাশাপাশি তার অভিযোগ, ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে। তার কথায় “সন্ত্রাস ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এর মূল কারণ দীর্ঘদিন ধরে দমিয়ে রাখা এবং সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমানদের বিষয়ে তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ”। আর কাশ্মীর ইস্যু “বৈশ্বিক বিষয়”।
ছবির উৎস, Ministry of Defence, India/Facebook
‘আমাদের পরিবারেরই অংশ’
কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি বার্ষিক বিজনেস সামিট ২০২৫-এ উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মঞ্চে ভাষণের সময় উঠে আসে পাকিস্তানের প্রসঙ্গ।
এসময় রাজনাথ সিং বলেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ এবং আলোচনার বিষয়টা নিয়ে আমরা পুনর্মূল্যায়ন করেছি। যখনই আলোচনা হোক, তা হবে শুধু সন্ত্রাসবাদ ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে।”
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বিষয়েও মন্তব্য করেন তিনি। তার কথায়, “আমি বিশ্বাস করি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জনগণ আমাদের নিজেদের। তারা আমাদের পরিবারেরই অংশ। আমরা এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত-এর সংকল্পের প্রতি দায়বদ্ধ।”
“আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস যে আমাদের ভাইয়েরা যারা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে আজ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা একদিন অবশ্যই আত্মসম্মান নিয়ে, স্বাধীন ইচ্ছায় ভারতের মূলধারায় ফিরে আসবেন।”
কিছু মানুষকে ‘ভুল বোঝানো হয়েছে’ বলে অভিযোগ তোলেন তিনি।
মি. সিং বলেছেন, “আমি জানি, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষই ভারতের সঙ্গে এক ধরনের সংযোগ অনুভব করেন। কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ রয়েছে, যাদের ভুল বোঝানো যারা হয়েছে। ভারত সবসময় হৃদয়ের সংযোগে বিশ্বাস করে।
প্রসঙ্গত, পহেলগাম হামলার কয়েকদিন আগে এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের আসিম মুনিরকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে “বিশ্বের কোনো শক্তি কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে পারবে না”।
কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জাগুলার ভেইন’ (যা মস্তিষ্ক, ঘাড়, মুখের একাংশ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে দেয়) বলে অভিহিত করেছিলেন তিনি। পহেলগাম হামলার পর, তার সেই মন্তব্যকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়।
তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মীরের বিষয়ে আমাদের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট, এটা আমাদের জাগুলার ভেইন ছিল এবং থাকবে। আমরা একে ভুলব না। আমরা আমাদের কাশ্মীরি ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ত্যাগ করব না।”
পাশাপাশি উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়ে অবগত করতে হবে।
তিনি বলেছিলেন, “আপনাদের সন্তানদের পাকিস্তানের কথা বলতে হবে যাতে তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তা-ভাবনাকে ভুলে না যায়, ভুলে না যায় যে আমরা হিন্দুদের থেকে আলাদা। আমাদের ধর্ম, রীতিনীতি, ঐতিহ্য, চিন্তা-ভাবনা, উদ্দেশ্য সবই আলাদা।”
তার বক্তব্যে বিভাজনমূলক বিষয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
এদিকে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী’ কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ আরও একবার তুলেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, “সন্ত্রাসের ব্যবসা চালানোটা ব্যয়সাশ্রয়ী বিষয় নয়। পাকিস্তান আজ বুঝতে পেরেছে যে এর জন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে। আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কৌশল এবং প্রতিক্রিয়া উভয়কেই নতুন করে ডিজাইন ও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছি।”
ছবির উৎস, ANI
পরে সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিং-এ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে পাকিস্তানের বিষয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে একাধিক প্রশ্ন করা হয়।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মি. জয়সওয়াল বলেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট ও ধারাবাহিক। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো আলোচনা শুধু দুই দেশের মধ্যে, অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিকই হতে হবে।”
“একই সঙ্গে আমরা এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছি যে আলোচনা ও সন্ত্রাস একসঙ্গে চলতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে আলোচনা হলে যে বিষয়ে হবে তা হলো যে সমস্ত সন্ত্রাসবাদীদের নামের তালিকা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে, তাদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হোক।”
দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার আবহে সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত করা হয়েছিল। সেই চুক্তি এখনো স্থগিত রয়েছে।
মি. জয়সওয়ালকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, “সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে বলব, যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করা বন্ধ করছে, ততদিন এই নিয়ে কোনো কথা হবে না। যেমনটা প্রধানমন্ত্রী আগেই বলেছেন।”
“আমি তার কথাগুলো আবারও বলতে চাই। সন্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না, সন্ত্রাস আর বাণিজ্য একসঙ্গে চলতে পারে না এবং জল ও রক্ত একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না।”
ছবির উৎস, Reuters
‘কাশ্মীর নিয়ে সমঝোতা সম্ভব নয়’
একদিকে, দিল্লি যেমন নিজেদের অবস্থান আবার স্পষ্ট করেছে, পাকিস্তানও করেছে।
ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির বৃহস্পতিবার পাল্টা বলেছেন, “ভারতের জানা উচিত যে পাকিস্তান কখনোই কাশ্মীর ছেড়ে যাবে না। সন্ত্রাসবাদ ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সংখ্যালঘুদের, বিশেষত মুসলমানদের ওপর ক্রমবর্ধমান নৃশংসতা ও বৈষম্যের কারণে তৈরি হয়েছে। আর কাশ্মীর একটা বৈশ্বিক ইস্যু।”
এক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অধ্যক্ষ ও প্রবীণ শিক্ষকদের সঙ্গে মতামতের সময় এই কথাগুলো বলেন তিনি।
আসিম মুনির বলেছেন, “কাশ্মীর নিয়ে কোনো রকম সমঝোতা হওয়া সম্ভব নয়। ভারত কয়েক দশক ধরে কাশ্মীর ইস্যুকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না।”
সিন্ধু জলের প্রসঙ্গও উঠে আসে তার বক্তব্যে।
তার কথায়, “২৪ কোটি পাকিস্তানির মৌলিক অধিকারের সঙ্গে আপস করতে দেওয়া হবে না। পাকিস্তান কখনোই ভারতের একচেটিয়া আধিপত্য মেনে নেবে না।”
পাশাপাশি ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির দাবি করেছেন, “বালুচিস্তানের সন্ত্রাসীরা ফিতনা-উল-হিন্দুস্তান (ভারতের তৈরি সমস্যা) । তাদের সঙ্গে বালোচের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা রাষ্ট্রকে দুর্বল করার জন্য ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা করে, রাষ্ট্রের উচিত তা প্রত্যাখ্যান করা।”
“পাকিস্তানকে এমন এক শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে যেখানে সব প্রতিষ্ঠান কোনো রাজনৈতিক চাপ, আর্থিক ও ব্যক্তিগত লাভবান না হয়ে আইন মেনে, সংবিধানের অধীনে থেকে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করবে।”
প্রসঙ্গত, বালোচিস্তানের প্রসঙ্গে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছে, দিল্লি তা আগেই খারিজ করে দিয়েছে।
ছবির উৎস, AFP via Getty Images
আন্তর্জাতিক মহলের কাছে দুই দেশের প্রতিনিধি
পহেলগাম হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা দেখা গিয়েছিল, সেই বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের দেশের অবস্থান স্পষ্ট করতে সচেষ্ট হয়েছে দুই দেশ। দুই দেশই আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এটা স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছে যে তারা ‘শান্তির পক্ষে’।
ভারত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মিলিয়ে তৈরি সাতটা দল পাঠিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। সেখানে তারা ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপের’ বিষয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছে।
পাশাপাশি জানিয়েছে পহেলগাম হামলার পর ছয় ও সাতই মে-র মধ্যবর্তী রাতে পাকিস্তানের ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটিকে’ নিশানা করে চালানো অভিযানের প্রয়োজন কেন পড়েছিল।
অন্যদিকে, পাকিস্তানও একই কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়। ভারতের বিরুদ্ধে ‘অভিসন্ধিমূলক প্রচারের’ অভিযোগ তুলে তারাও উচ্চস্তরের প্রতিনিধি মহল পাঠায় বিভিন্ন দেশে। এই তালিকায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারসহ অনেকে ছিলেন।