Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল
রফিক মোহাম্মদ
• সীমান্তে নির্মাণ হচ্ছে ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক
• ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে পার্বত্যাঞ্চল
• পর্যটনশিল্পের বিকাশ হবে, কমবে মাদক-সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্য
• পাহাড়িদের জীবনমানে আমূল পরিবর্তন আসবে
• আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি পাহাড়ে ফেরাবে স্বস্তি
পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নির্মাণ হচ্ছে প্রায় এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সড়ক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হচ্ছে এ সড়ক। তিন ধাপের এ নির্মাণকাজের প্রথম ধাপ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ হলেই পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি অঞ্চলে তৈরি হবে অর্থনীতির শক্ত ভিত।
পাশাপাশি যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটন বিকাশে এবং চোরাচালান, অস্ত্র ও মাদকপাচার, সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে এ সীমান্ত সড়ক। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড।
জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর, বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ও জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে।
সীমান্ত সড়কটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা সদর, বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ও জুরাইছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। সড়কটি বরকল ও বাঘাইছড়ি এবং খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা হয়ে রামগড় উপজেলা সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে
সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে আঁকাবাঁকা এ সড়ক। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সড়কে সংযুক্ত হবে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলা। ২০৩৬ সালের মধ্যে পুরো এই এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
প্রথম ধাপের ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। এ সড়ক ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা জানান, আয়তনে ক্ষুদ্র এবং আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক পর্যটন স্পটের স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটন সেভাবে বাড়ছে না। যে কয়টি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোতে মানুষ যেতে যেতে অনাগ্রহী হয়ে উঠবে একসময়। এতে দেশের মানুষ ভ্রমণপিপাসা মেটাতে বিদেশমুখী হবে। এতে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশেই চলে যাবে।
আরও পড়ুন
ফলে পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও অর্জন করতে বাংলাদেশে নতুন নতুন পর্যটন স্পট এক্সপ্লোরেশন করার বিকল্প নেই। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া দেশে এমন সম্ভাবনাময় স্থান খুবই অপ্রতুল। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্গমতার কারণে এ সম্ভাবনা ফিকে হয়েই রয়ে গেছে। এবার সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন সীমান্ত সড়ক সে সুযোগের দ্বার উন্মোচন করছে।
অসুখ হলে পরিবারের সদস্যদের হাসপাতালে নেওয়া যেতো না। পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। এখন সড়ক হওয়ার কারণে সবকিছু সহজ হবে। আর্মির করে দেওয়া স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনাও করছে।- ডায়মন্ড ম্রোং
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সীমান্ত সড়কের কারণে পাহাড়ে পর্যটন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্গমতা ও অবকাঠামো সংকটে পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন স্পট গড়ে ওঠেনি, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে সেখানে নতুন নতুন পর্যটন স্পট তৈরি হবে। খুব সহজেই দেশ ও বিদেশের পর্যটকরা সীমান্ত সড়ক ব্যবহার করে সেসব স্পট ভ্রমণ করতে পারবেন।
যোগাযোগের উন্নতি সাধনের ফলে শুধু পর্যটকদের ভ্রমণই নয়, পাহাড়ে উৎপাদিত ফল, ফসল ও বিভিন্ন পণ্যের ভালো বাজারও তৈরি হবে। এতে একদিকে যেমন পাহাড়ি জনপদে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে সেখানকার অর্থনীতিতে আসবে নতুন জোয়ার।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সীমান্ত সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে পাহাড়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন আসবে। দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেসব অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছিল, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব সহজেই এবং দ্রুত ওইসব অঞ্চলে পৌঁছাতে পারবে। ফলে সন্ত্রাসীদের পক্ষে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
পাহাড়ি দুর্গম এলাকার মানুষকে জিম্মি করে বছরজুড়েই চলে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নির্যাতন। দুর্গমতার কারণে সেখানকার সাধারণ মানুষ এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহস করেন না। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হলে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল ও যাতায়াতের ফলে স্থানীয়দের সাহস ও আস্থা বাড়বে। তারা সহজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহলের ফলে চাঁদাবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম কমে আসবে। এতে স্থানীয় জনগণের জীবনের নিরাপত্তাও বহুগুণে বেড়ে যাবে।
এছাড়া সীমান্তে পুলিশ, বিজিবির পেট্রোলিং সহজ হওয়ার মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে এ পার্বত্য সড়ক নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরই মধ্যে স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সীমান্ত সড়কের বিরোধিতা থেকে বোঝা যায়, এ সড়ক নেটওয়ার্ক তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেসব অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছিল, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব সহজেই এবং দ্রুত ওইসব অঞ্চলে পৌঁছাতে পারবে। ফলে সন্ত্রাসীদের পক্ষে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।- কর্নেল দেলোয়ার হোসেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় বা নির্দেশে পাহাড়ের সাধারণ কৃষকদের ভূমির কিছু অংশে গাঁজা ও পপির মতো মাদক চাষ করা হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত সড়ক যোগাযোগের অভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সময় এসবের খোঁজ পায় না। অভিযানও চালাতে পারে না।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন খুব সহজেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। এছাড়া গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের অংশ হিসেবে এ অঞ্চলে আন্তঃসীমান্ত মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। যেখানে সীমান্তে পুলিশ ও বিজিবির পেট্রোলিং সহজ হবে।
জানা যায়, সীমান্ত সড়ক শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে তা-ই নয়, বরং এটি আঞ্চলিক তথা বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নেও বিশাল ভূমিকা রাখবে। এ সীমান্ত সড়কের ফলে রামগড়-সাবরুম, থেগামুখ স্থলবন্দর, ঘুমধুম-মংডু ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সুযোগ বাড়াবে। সীমান্ত হাটগুলো কার্যকর হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। যা হয়ে উঠতে পারে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
বান্দরবানের থানচি উপজেলার বাসিন্দা কৃষক ডায়মন্ড ম্রোং জাগো নিউজকে বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের উৎপাদিত ফসল বাজারে নিয়ে যাওয়া যেতো না। এগুলো পচে নষ্ট হতো। বড় কোনো অসুখ হলে পরিবারের সদস্যদের হাসপাতালে নেওয়া যেতো না। পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। এখন সড়ক হওয়ার কারণে সবকিছু সহজ হবে। আর্মির করে দেওয়া স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনাও করছে। এখন খুব ভালো লাগছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের আওতাধীন ১৭ ইসিবির প্রকল্প পরিচালক কর্নেল দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেসব অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছিল, সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব সহজেই এবং দ্রুত ওইসব অঞ্চলে পৌঁছাতে পারবে। ফলে সন্ত্রাসীদের পক্ষে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
সেনাবাহিনীর দুর্গম পাহাড়ে করা এ সড়ক অনেকটা মহাযজ্ঞ বলা যায়। এতে পাহাড়িদের জীবনমান উন্নত হবে। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।- প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন
‘একই সঙ্গে দুর্গম এলাকার মানুষকে জিম্মি করে তারা যেভাবে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নির্যাতন চালিয়ে আসছিল, দুর্গমতার কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহস করতো না, এখন সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত টহল ও যাতায়াতের ফলে মানুষের সাহস ও আস্থা বাড়বে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে সাহসী হবে।’
তিনি আরও বলেন, এই পার্বত্য সড়কের ফলে রামগড়-সাবরুম, থেগামুখ স্থলবন্দর, ঘুমধুম-মংডু ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সুযোগ বাড়বে। সীমান্ত হাটগুলো কার্যকর হতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যে কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানেই সমাজ ও রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়া। সেনাবাহিনীর দুর্গম পাহাড়ে করা এ সড়ক অনেকটা মহাযজ্ঞ বলা যায়। এতে পাহাড়িদের জীবনমান উন্নত হবে। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।
এমকেআর/এমকেআর/এমএস