Google Alert – সামরিক
প্রেস টিভি
ইরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তেল আবিবের দক্ষিণে রিহবেত শহরে ইসরাইলের বিখ্যাত সামরিক-সংশ্লিষ্ট গবেষণাগার ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ‘পুরোপুরি ধ্বংস’ হয়ে গেছে। সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ইসরাইলি শাসনব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ও সামরিক গবেষণার মূল ভিত্তি হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি এখন কার্যত অচল ও বিধ্বস্ত।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুসারে ইরানের সুনির্দিষ্ট এই হামলাকে ‘ভুল করে আক্রমণ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। বরং এর লক্ষ্য ছিল পদার্থবিদ্যা, বায়োটেকনোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ সামরিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ এই কেন্দ্রটিকে গুঁড়িয়ে দেয়া। ইসরাইলি টেলিভিশন চ্যানেল ১৩-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট আলোন চেন স্বীকার করেছেন যে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকা- কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোয় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে আঘাত করায় এর ব্যাপক ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এবং আমাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন ৩০০ মিলিয়ন ডলার থেকে অর্ধবিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়।’ এ বিষয়ে চেনের ব্যাখ্যা, কমপ্লেক্সটির দু’টি অংশ ছিল : একটি ছোট আবাসিক ও অন্যটি বৃহৎ বৈজ্ঞানিক অংশ। এর মধ্যে ইরান তুলনামূলকভাবে বড় অংশটিতে আঘাত করেছে। অর্থাৎ তারা ইনস্টিটিউটের হৃৎপিণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করেছে এবং তাদের হামলা ছিল অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট।
ক্ষয়ক্ষতির ছবি প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, ‘ইরান যাতে এসব স্থাপনায় আবারো আঘাত করতে না পারে সে জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ তার ভাষ্য, ‘এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ইরানিরা ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। শুধু ভাইসমান ইনস্টিটিউটই নয়, অনেক সামরিক ঘাঁটি ও কৌশলগত স্থান, যেগুলো এখনো আমরা প্রকাশ্যে আনিনি।’ চ্যানেল-১৩ বলছে- পরিস্থিতি এমন যে, ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা ইরানের সুনির্দিষ্ট হামলা, ব্যাপ্তি ও অনেক জায়গার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখনো অবগত নন। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও যেসব ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠেছে।
কয়েক দশকের গবেষণার ক্ষতি
গত ১৫ জুন ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইল অধিকৃত অঞ্চলে তৈরি করা ভাইসমান ইনস্টিটিউটের বড় ধরনের ক্ষতি হয়। কমপ্লেক্সটির একাধিক অংশকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। একটি নবনির্মিত রাসায়নিক ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এটি এ বছরই চালু হওয়ার কথা ছিল। জীবন ও গণনামূলক বিজ্ঞানচর্চার জন্য নিবেদিত ভবনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্তত একটি ল্যাবে আগুন লেগেছে। এই স্থাপনাটিতে ক্যানসার ও কোষ পুনরুৎপাদনের ওষুধসহ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্প চলছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘কার্ডিয়াক রিজেনারেশন’ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এলদাদ জাহরের। তার ২২ বছরের গবেষণার ফসল- হৃৎপিণ্ডের হাজারো টিস্যু, ডিএনএ ও আরএনএ, অ্যান্টিবডি ও ল্যাবে তৈরি ভাইরাসের নমুনাসহ সবই ধ্বংস হয়ে গেছে।
তিনি তার গবেষণাগার ধ্বংসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘গত ২২ বছর ধরে ল্যাবটি আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছিল। দেখলাম যে ১৫ মিনিটের মধ্যেই আগুন সেটিকে কিভাবে গ্রাস করছে। ভবনের তিনটি তলা পুরোপুরি ধসে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই- কোনো তথ্য নেই, ছবি নেই, নোট নেই, কোনো ইতিহাস নেই।’
সামরিক-সংশ্লিষ্টতা
ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সকে ‘বেসামরিক’ বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং এখানকার অনেক গবেষণা নিবন্ধ অ্যাকাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। তবে এর অনেক প্রকল্প সামরিক গবেষণার সাথে জড়িত, যা কখনোই প্রকাশ্যে আনা হয় না। ইসরাইলি ও পশ্চিমা মিডিয়া প্রায়ই এই ইনস্টিটিউটের মৌলিক ও প্রায়োগিক বিজ্ঞানের অর্জনগুলোকে তুলে ধরে, সামরিক-সংশ্লিষ্টতাকে হালকা করে দেখায়।
তবে ভাইসমান ইনস্টিটিউট ‘এলবিত সিস্টেমস’র মতো সামরিক ঠিকাদারদের সাথে যৌথভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি, দ্বৈত-ব্যবহার্যসামগ্রী উদ্ভাবন ও পারমাণবিক গবেষণার মধ্য দিয়ে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সাথে স্পষ্ট ও নথিভুক্ত সংযোগ বজায় রেখে চলে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে এই ইনস্টিটিউট এলবিত সিস্টেমসের সাথে চুক্তির ঘোষণা দেয়, যেখানে ‘সামরিক প্রয়োগের জন্য জীব-অনুপ্রাণিত উদ্ভাবনী উপাদান’ তৈরির কথা বলা হয়। এটি স্পষ্টত সামরিক প্রযুক্তির উন্নয়নের ধারণা দেয়।
এ ছাড়াও, ভাইসমান ইনস্টিটিউট ‘এলবিত সিস্টেমস’র সাথে ইসরাইলি আল্ট্রাভায়োলেট ট্রান্সিয়েন্ট অ্যাস্ট্রোনমি স্যাটেলাইট (আল্ট্রাসেট) প্রোগ্রামে অংশ নেয়। এর উদ্দেশ্য এক দিকে ছিল বৈজ্ঞানিক, অন্য দিকে দ্বৈত-ব্যবহার। কাছেই কিয়াত ভাইসমান সায়েন্স পার্কে উল্লেখযোগ্য ইসরাইলি অস্ত্র তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান- রাফাল, ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই) ও এলবিত সিস্টেমসের অফিস আছে। এটি গবেষণা- উন্নয়ন পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে ইনস্টিটিউটের কাজ পরোক্ষভাবে প্রতিরক্ষা খাতকে সহায়তা করে।
শিকড় অনেক গভীরে
১৯৪৮ সালে নাকবার সময় ভাইসমান ইনস্টিটিউটের যন্ত্রপাতি ও ক্যাম্পাস সরঞ্জামাদি সরাসরি জায়নিস্ট প্যারামিলিটারি দল হাগানাহর কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে নতুনভাবে গঠিত ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কাজেও তা ব্যবহৃত হয়। ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও প্লাস্টিক বিস্ফোরক, রকেট, মর্টার ও কামান শেল, ন্যাপালম, টিয়ার গ্যাস ও মাইনসহ নানা ধরনের সমরাস্ত্র তৈরিতে যুক্ত।
নাকবার শেষের দিকে এই ইনস্টিটিউট সামরিক বিজ্ঞান দলের মূল ভিত্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং টেকনিয়নকে সাথে নিয়ে ইসরাইলি শাসনব্যবস্থার প্রধান সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উভয় প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ প্রশাসক ও শিক্ষকরা ইসরাইলের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা ইসরাইলি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সামরিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ধারণাকে সমর্থন করেন, দেশীয় উন্নয়ন ও উন্নত অস্ত্র তৈরির জন্য চাপ দেন।
পরমাণু প্রকল্পের মাস্টারমাইন্ড
ভাইসমান ইনস্টিটিউট দীর্ঘ সময় ধরে ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত। কেননা, ১৯৫২ সালে গঠিত ইসরাইলের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন আর্নস্ট ডেভিড বার্গম্যান। বার্গম্যানকে ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের মূল কারিগর হিসেবে ধরা হয়। ১৯৫০-এর দশকে এই ইনস্টিটিউট নেগেভ মরুভূমি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কাজে অবদান রাখে।
অনেক বিজ্ঞানী ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্পের মূল কেন্দ্র শিমন পেরেস নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারে (ডিমোনা) কাজ করেছেন। তারা ভাইসমান ইনস্টিটিউটের স্নাতক কিংবা শিক্ষক ছিলেন। ২০১৪ সালে সিনসিনাতি বিশ্ববিদ্যালয় ও তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, এই ইনস্টিটিউট পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞদেরও প্রশিক্ষণ দেয়।