ফিল্ড মার্শাল সমাচার ও পাকিস্তানের রাজনীতি

Google Alert – সেনাপ্রধান

পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের ফিল্ড মার্শাল হওয়ার ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। আর এ পদোন্নতির পর সম্প্রতি তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে আরো চমক দেখিয়েছেন। গত ১৮ জুন হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেয়ার আগে পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধে সাফল্যের জন্য ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলে বেশ হাসির খোরাক হয়েছেন তিনি। এর সাথে এটা বোঝা যায়, জেনারাল মনিরের ফিল্ড মার্শাল হওয়ার নেপথ্যে একটি বড় রাজনৈতিক অভিসন্ধি লুকিয়ে রয়েছে। কারণ সিদ্ধান্তমূলক কোনো যুদ্ধে বিজয় অর্জন ছাড়া এ ধরনের পদোন্নতির ঘটনা গৌরবের থেকে রাজনৈতিক অভিসন্ধি হিসেবে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে এটি সত্য, ভারতের নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিমানবাহিনী অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। একই সাথে এটিও সত্য, পাকিস্তান এ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তার সামরিক সক্ষমতা বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যে কাশ্মির ইস্যু নিয়ে দু’টি দেশ বারবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সেই ইস্যু যাকে গত ১৭ মে জেনারেল মুনির জীবনসঞ্চারণী শিরা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন সেই কাশ্মির ইস্যুতে সামান্যতম সফলতা আসেনি। কিংবা সিন্ধু নদীর পানি ইস্যু একই জায়গায় রয়েছে। পাকিস্তান তখন সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ করাকে যুদ্ধ ঘোষণায় শামিল হিসেবে দেখেছিল। এখনো তার কোনো সমাধান হয়নি।

অথচ জেনারেল আসিম মুনির যুদ্ধবিজয়ী হিসেবে ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি পেয়ে গেলেন। গত শতকের ষাটের দশকে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে জেনারেল আইয়ুব খান নিজেই নিজেকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে যে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছিলেন ৬০ বছর পর তার ধারাবাহিকতায় আরেকটি ঘটনা ঘটল। আর এটি সবাই জানেন যে, পাকিস্তানের প্রথম ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কিভাবে স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন এবং অতঃপর ৬৯ সালে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার পর হারিয়ে যান ইতিহাসের অন্তরালে।

সাধারণত যুদ্ধে অসামান্য সাফল্যের জন্য ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত যারা ফিল্ড মার্শাল হয়েছেন তাদের অনেকে ছিলেন যুদ্ধবিজয়ী বীর। কিংবা তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হলেও ফিল্ড মার্শাল রোমেল ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। যাকে বলা হয় ‘ডেজার্ট ফক্স’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় উত্তর আফ্রিকায় ফিল্ড মার্শাল রোমেল এমন সব যুদ্ধকৌশল প্রদর্শন করেন যা বর্তমান যুগেও অনুসরণ করা হয় এবং সামরিক বাহিনীতে পড়ানো হয়। সে কারণে তার শত্রুরাও তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরাজিত হলেও পৃথিবীর ফিল্ড মার্শালদের তালিকায় শীর্ষের দিকে রয়ে গেছে তার নাম।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে রোমেল হেরে গিয়েছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সফল সমরনায়ক ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমারির কাছে। আর ব্রিটিশ এ জেনারেল ছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিজয়ী বীর। তার যুদ্ধ বিজয়ের কাহিনী কিংবদন্তিতুল্য। তার এ অসামান্য সব কৃতিত্বের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জেনারেল মন্টগোমারিকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেন। তাই ইতিহাসের পাতায় মন্টগোমারি সেরাদের সেরা হয়ে আছেন।

আরো কাছের ভারতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, জেনারেল মানেকশ ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। এ সাফল্যের জন্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল মানেকশকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেন।

আবার যুদ্ধে বিশাল জয়লাভের পরও পদোন্নতি পাননি এমন ঘটনা আছে। যেমন- ১৯৬৭ সালের ইসরাইল-আরব যুদ্ধের কথা ধরা যাক। মাত্র ছয় দিনের ওই যুদ্ধে ইসরাইল মিসর, সিরিয়ার বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছিল। ধ্বংস করে দিয়েছিল তাদের বিমান শক্তি। পরাজিত করেছিল জর্দানকে। জেরুসালেম দখল করে নিয়েছিল। সে যুদ্ধে ইসরাইলের সেনাপ্রধান ছিলেন লে. জেনারেল আইজ্যাক রবিন। যদিও এটি ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বোচ্চ পদ। তবু এই বিশাল বিজয়ের পুরস্কার হিসেবে তাকে চার তারকা জেনারেল পদে উন্নীত করা কিংবা অন্য কোনো বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি। তবে অবসর গ্রহণের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তার পর অবশ্য তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পান নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং নিহত হন আততায়ীর গুলিতে। মুসলমানদের প্রতি চরম ঘৃণা বিদ্বেষ পোষণকারী, নৃশংস নিরীহ মুসলিম নারী শিশু সাধারণ মুসলিম হত্যাকারী হওয়া সত্ত্বেও দেশটির অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য অনেকে তার প্রশংসা করেন।

কিন্তু পাকিস্তান একটি মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কারণে ১৯৭১ সালে দেশটি তার পূর্বাঞ্চল হারিয়েছে এবং এখনো যে পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছে তাও স্বস্তিদায়ক নয়। পাকিস্তানের সামন্ত এলিটদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত শাসক চক্র এ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী।

এই চক্র এখন জেনারেল আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল করেছে তাদের কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করার জন্য, যুদ্ধে জয়ের জন্য নয়। বলা যেতে পারে, ‘চব্বিশের সাধারণ নির্বাচনে সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির যেভাবে নগ্ন কারচুপিকে সহায়তা করে শরিফ-জারদারি অর্থাৎ মুসলিম লিগ-পিপিপি জোটকে বিজয়ী করেছিলেন তার পুরস্কার হিসেবে এই ফিল্ড মার্শাল পদ। জেনারেল মুনির দুর্নীতিগ্রস্ত ওই জোটকে বিজয় করে মূলত পাকিস্তানের বিভক্ত সমাজকে আরো তীক্ষèভাবে বিভক্ত করেছেন। যদি এমন হতো, জেনারেল মুনির যুদ্ধে যাওয়ার আগে ইমরান খানকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন তাহলে হয়তো চমৎকার একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। ফলে এটি বোঝা যায়, তিনি ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষে পরিচালিত হয়েছেন যার উদ্দেশ্য ছিল তার ধসে যাওয়া ইমেজ পুনরুদ্ধার করা। কিছুটা হলেও আপাতত তিনি তা করতে পেরেছেন।

তবে আগামীতে আরো কঠিন দিন আসতে পারে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও বিভক্ত সমাজের বিভক্তি আরো তীব্র আকার ধারণ করলে। তখন মানুষের কাছে ধীরে ধীরে নেপথ্য অভিসন্ধিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেই সময় এ বিজয়ের উচ্ছ্বাস নিঃশেষ হয়ে যাবে। কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনৈতিক শাসন কখনো শুভ ফল বইয়ে আনতে পারে না। যেমনটি এ ধরনের শাসনের কারণে আইয়ুব খানের ফিল্ড মার্শাল পদটি নিয়ে কেউ আর গৌরব করেন না; তেমনি এক দিন একই অবস্থা ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের ভাগ্যে জুটলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *