Google Alert – ইউনূস
জুলাই আন্দোলনের ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ নিয়ে মুখ খুলেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
যাকে প্রধান উপদেষ্টা আওয়ামী লীগ সরকার পতন আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছিলেন তার ভাষ্য, “প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। পরের অংশের কৃতিত্ব বিপ্লবী ছাত্র-জনতার।”
বহুল আলোচিত জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ নিয়ে শুক্রবার ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে চলমান রাজনৈতিক আলাপে অংশ নিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা।
তার আাগে বৃস্পতিবার আরেকটি পোস্টে তিনি দাবি করেন, ‘মব ভায়োলেন্স’ বা সংঘবদ্ধ আক্রমণের সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কোনো সম্পর্ক নেই।
এটিকে ‘সামাজিক ফ্যাসিবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মাহফুজ বলেছেন, শেখ হাসিনার গত ১৬ বছরের রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদেরই ‘প্রতিক্রিয়া’ এই সামাজিক ফ্যাসিবাদ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলে দুই মাস আগে দেওয়া এক বক্তব্যের পর রাজনৈতিক চাপে পড়েছিলেন মাহফুজ। এরপর থেকেই সমসাময়িক বিষয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
তবে গত ২৪ ঘন্টায় নিজের ফেইসবুকে পর পর ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ ও ‘মব’ নিয়ে দুটি পোস্ট দেন তিনি। এর একটি ২৩ ঘন্টায় সাড়ে ছয়শ ও আরেকটি এক ঘন্টায় দেড়শ শেয়ার হয়েছে। মন্তব্যের ঘর অবরুদ্ধ।
‘মেটিকুলাস ডিজাইনে সমস্যা কোথায়?’
গত বছরের জুলাই মাসে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দেওয়া এক বক্তব্যে ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
সে বছর ৫ জুন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে দুটি গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট রায় দেয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল সরকার।
পরিপত্র বাতিল করে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের পর গত বছর ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যার লিয়াজোঁ কমিটির সম্বয়য়ক ছিলেন মাহফুজ আলম।
সেই আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হন। দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা সাঈদকে গুলি করার ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গণঅভ্যুত্থানে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
জুলাই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বর্ণনা করতে ইউনূসের সেই ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ শব্দ দুটি ব্যবহার করে থাকেন দেশের বাইরে অবস্থানরত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা লিখেছেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের দুটি অংশ। ৫ জুন থেকে ১৮ জুলাই। এ অংশে অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট এবং নেতৃত্ব তৈরি হয়েছিল। আর ১৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সকল স্তরের ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে এবং আত্মদানে অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। প্রথম অংশ অবশ্যই মেটিকুলাসলি ডিজাইনড। পরের অংশের কৃতিত্ব বিপ্লবী ছাত্র-জনতার।”
অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা এবং সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না থাকলে এ বিপ্লবী জনতা পরের অংশে লক্ষ্যে পৌছাতে পারত না মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, “শুক্রবার দিবাগত রাত, ২ আগস্টে এ অভ্যুত্থান বেহাত হয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের দিকে মোড় নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তা ঠেকাতে পেরেছিল অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব।”
অতীতে বাংলাদেশের অনেক গৌরবময় আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামে ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ কাজ করেছিল বলে দাবি করেন মাহফুজ।
তিনি বলেছেন, “পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে মেটিকুলাস ডিজাইন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান আর ৭১ এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন ও বাঙ্গালি-বিহারি দাঙ্গা সঠিক হইতে পারলে ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান মেটিকুলাস ডিজাইন হইলে সমস্যা কোথায়?”
“দুনিয়ার কোন অভ্যুত্থান বা বিপ্লব পরিকল্পনা না করে হয়েছে? জনগণের চৈতন্যকে ঐক্যবদ্ধ ও লক্ষ্যাভিমুখী রাখতে মেটিকুলাস ডিজাইনের বিকল্প নেই। যখন জনগণ নেতৃত্ব ও বক্তব্য পেয়ে যাবে এবং বিপ্লবের অবজেক্টিভ কন্ডিশন প্রস্তুত, তখন আর প্ল্যানের দরকার পড়ে না। কিন্তু, তার আগে রাজনৈতিকভাবে জনগণকে প্রস্তুত এবং বিপ্লবী করে তোলা মেটিকুলাস ডিজাইন হলে সমস্যা কোথায়?”
এই ধরনের ডিজাইন বা পরিকল্পিত আন্দোলনের জন্য গর্ব বোধ করার কথা তুলে ধরে মাহফুজ লিখেছেন, “সিরাজুল আলম খান, তাজউদ্দিন, সিরাজ শিকদার আর ভাসানী, এমনকি খোদ শেখ মুজিব যদি পাকিস্তানকে পরাজিত করতে মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ হয়ে পাপবোধ না করেন এবং আমরা তাদের নিয়ে (তাদের ভুলসহই, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য) গর্বিত হতে পারি, তাহলে ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে মেটিকুলাস ডিজাইন করে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করলে কেন এ প্রজন্ম গর্বিত বোধ করবে না?”
আন্দোলনের সঙ্গে বিদেশি শক্তির সম্পৃক্ততা ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি।
ফেইসবুকে মাহফুজ লিখেছেন, “৩ তারিখের ১ দফা ঘোষণার আগে জাতিসংঘের বক্তব্য ছাড়া বিদেশি শক্তি বা সামরিক বাহিনী কারোরই বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ ছিল না এ গণ-অভ্যুত্থানে। ভারতের সাথে ষড়যন্ত্র করে (যা ন্যায্য বলেই আমরা মনে করি) আগরতলা বৈঠক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য শেখ মুজিব ও অন্যান্য জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি যদি আমাদের শ্রদ্ধা থাকে, তাহলে কোনো বিদেশি শক্তি বা তৃতীয় শক্তির সাথে ষড়যন্ত্র কিংবা সলা-পরামর্শ ছাড়াই জনগণের অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলার জন্য অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দ এবং অংশীজনকে কেন গালি শুনতে হবে?”
“মওলানা ভাসানীর ৬৮ সালের ঘেরাও আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ মিলিয়ে দেখেন, অথবা ৭১ এর মার্চ। আপনারা মেটিকুলাস ডিজাইনও বুঝতে পারবেন এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ, প্রতিরোধ আর বিপ্লবী তৎপরতারও হদিস পাবেন,” লিখেছেন তিনি।
এ বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে আরও কথা বলার জন্য ফোন করা হলেও তিনি ফোন কেটে দেন।
‘জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা মব না’
মব তৈরি করে হামলার বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা লিখেছেন, “মব মানে বিপ্লবী উদ্দেশ্যহীন, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা লালন করা সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী। জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্য পরিষ্কার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা অতুল এবং তারাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।”
মবকে সামাজিক ফ্যাসিবাদ আখ্যায়িত করার পাশাপাশি তার দাবি, শেখ হাসিনার গত ১৬ বছরের রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদেরই ‘প্রতিক্রিয়া’ এই সামাজিক ফ্যাসিবাদ।
“সামাজিক ফ্যাসিবাদ যে হাসিনার ১৬ বছরের রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদেরই প্রতিক্রিয়া এবং বিকার, তা না বুঝে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও মব মানসিকতা মোকাবেলা অসম্ভব।”
‘ইসলামোফ্যাসিস্ট’ বলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না মন্তব্য করে তথ্য উপদেষ্টা লিখেছেন, জুলাই যে বিভিন্ন মতাদর্শ ও মতে বিশ্বাসীদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ তৈরি করেছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে এ সামাজিক ফ্যাসিবাদ দূর করতে হবে। এছাড়া, গত ১৬ বছরের গণতন্ত্রহীনতা এবং আইনের শাসনের অবক্ষয় যে মব মানসিকতার জননী, সে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে।
“কিন্তু, গত কয়েকমাসে রাজনৈতিক ও সামাজিক ফ্যাসিবাদের অংশীদার না হয়েও হরে দরে মব ভায়োলেন্সের দায় নিতে হচ্ছে জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতাকে। জুলাইয়ের পরে মব হইলে বা সে সুযোগ তৈরি করা হইলে এত সুশীলতা আর অ্যাপলোজেটিক আলাপ আসতো না।”
বিশৃঙ্খলার ইতিহাস টেনে তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশে প্রথম ‘মব ভায়োলেন্স’ হইসিল বিহারি জনগোষ্ঠীর উপর। তারপরে মব হইসে ছাত্র ও তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অথচ মুজিববাদবিরোধীদের উপর। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি ইন্ধনে গত ৫৩ বছর মব হইসে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর।
“মবের ডেফিনিশন স্ট্রেইচ করলে তথাকথিত জনতার আদালত, জনতার মঞ্চ ’৯৬, ২৮ শে অক্টোবর, শাহবাগ-সবই মব জাস্টিস, মব ভায়োলেন্স।”
তথ্য উপদেষ্টার মতে, রাষ্ট্রের দায়িত্বে থেকে তাদের কাজ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
সে জন্য মব নিয়ে কয়েকবার বলেছেন তিনি। সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনায়, মাজারে হামলা নিয়ে, বইমেলা নিয়ে কথা বলেছেন, লিখেছেন মাহফুজ।
অনেক রাজনীতিক ‘জুলাই বিপ্লবকে’ মব হিসেবে আখ্যায়িত করছেন দাবি করে তিনি এর সমালোচনা করেন।
মাহফুজ লিখেছেন, “উদ্বেগের বিষয় হল, জুলাই বিপ্লবকে এখন মুজিববাদী বাম এবং লীগের কালচারাল গুন্ডারা জুলাই পরবর্তী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সাথে মিলিয়ে এমনভাবে পোট্রে করসে, যেন জুলাই বিপ্লব শেখ মুজিবের নাতি জয়ের কথামত মবোক্রেসি ছিল।
“মবোক্রেসি হইলে জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা পুলিশ-আনসার বিহীন দেশকে এক-দেড় মাস নিরাপদ রাখতো না “
ওবায়দুল কাদেরকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ঘটনার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা সাজানো মন্তব্য করে মাহফুজ লিখেছেন, “এ স্ক্রিপ্ট বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে স্ক্রিপ্টরাইটাররা ভেবেছেন এজন্যই যে, বিপ্লবী ছাত্র-জনতা প্রতিশোধপরায়ন ছিল না। জুলাই বিপ্লবে দেশকে আধিপত্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত করা মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে মব বলে জুলাইকে বিষোদগার করা বন্ধ করুন।”
বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান মাহফুজ।
“আইনের ব্যত্যয় ঘটলে, সাম্প্রদায়িক কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটলে আইনের আশ্রয় নিন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জুলাই বিপ্লবের পক্ষের ছাত্র-জনতাকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। কিন্তু, মুজিববাদ ও আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আপনাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।”