দেশের নতুন ফলভাণ্ডার হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম

Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল

শাহ আলম নূর কাওসার আজম বান্দরবান থেকে ফিরে

দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির জোগানদানে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এক সময় যে অঞ্চলটি কেবল পাহাড়, বনভূমি ও পর্যটনের জন্য পরিচিত ছিল। এসব অঞ্চল দ্রুতই পরিণত হচ্ছে দেশের অন্যতম ফলভাণ্ডারে। আনারস, আম, লিচু, কমলা, আমলকী, কুল, ড্রাগন ফল থেকে শুরু করে স্ট্রবেরি ও অ্যাভোক্যাডোর মতো অপ্রচলিত ফলও এখন উৎপাদিত হচ্ছে পাহাড়ি জেলাগুলোতে। বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় আগামী পাঁচ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ফল উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন পার্বত্য তিন জেলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির কল্যাণে জুমচাষ ছেড়ে স্থায়ী বাগান করার প্রবণতা ও বিপণন আগের চেয়ে সহজ হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল চাষ বাড়ছে। পাশাপাশি শিক্ষিত উদ্যমী তরুণেরা এই খাতে আসায় নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে এখন ফলচাষ এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, তিন পার্বত্য জেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আম ২ লাখ টন, আনারস ২ লাখ টন ও পেঁপে ১ লাখ ৮১ হাজার টন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এই তিন জেলায় ৪০ হাজারের বেশি চাষি এখন ফল চাষে জড়িত। তাদের হাত ধরে পাহাড়ি এলাকায় আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, কমলাসহ ৪৪ জাতের ফল উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত ফলের পরিমাণ প্রায় ১৯ লাখ টন, যা সারা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ। ফলচাষি, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাধারণ ভোক্তাদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল চাষ বাড়ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে মৌসুমি ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কিছু ফল সারা বছর পাওয়া যায়। যার মধ্যে রসালো আম, মিষ্টি কাঁঠাল আর সুস্বাদু আনারসের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের মাটি বিদেশী ফল উৎপাদনেও দারুণ উপযোগী। ম্যাংগোস্টিন, রাম্বুটান, রসকো (স্থানীয় ভাষায় তাইথাক বা রক্তফল নামে পরিচিত), চিন্দিরা, আমড়া, আনোনা, মারফা, লংগান, প্যাশন ফ্রুট এ নামগুলো দেশী ফলগুলোর সাথে মিশে পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে। এ ফলগুলো এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ফলন হচ্ছে এবং স্থানীয় বাজারগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। বলা যায়, সারা দেশে বছরজুড়ে দেশের বাজারে যে পরিমাণ ফ

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন প্রকল্প’ এর প্রকল্প পরিচালক তালহা জুবায়ের নয়া দিগন্তকে বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে কৃষির রূপান্তর এখন বাস্তবতা। এক সময় যেখানে শুধু জুম চাষই ছিল ভরসা, সেখানে এখন আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষি পদ্ধতির প্রসার ঘটছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘টিস্যুকালচার ও হর্টিকালচার ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলে রোগমুক্ত ও উন্নত গুণমানের ফল, ফুল ও সবজির চারা উৎপাদন করা হচ্ছে টিস্যুকালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে। কলা, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল, অর্কিডসহ উচ্চমূল্যের ফল ও ফুলের চারা স্থানীয় চাহিদা পূরণে যেমন সহায়তা করছে, তেমনি কৃষকদের আয়ও বাড়াচ্ছে।

বান্দরবান হর্টিকালচার সেন্টারের প্রজেক্ট ডিরেক্টর লিটন দেবনাথ নয়া দিগন্তকে বলেন ‘আমরা চেষ্টা করছি স্থানীয় পর্যায়ে ঠাণ্ডা সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার। কিছু স্থানে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে কোল্ডস্টোরেজ প্রকল্প নেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, এ দিকে জুম চাষের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সরে এসে বাণিজ্যিকভাবে আম, কমলা, কাজুবাদাম, কফি, গোলমরিচসহ ফল ও মসলা ফসলের চাষে আগ্রহ বাড়ছে। মাল্টি লেয়ার ফার্মিংয়ের মাধ্যমে একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করে মাটি ক্ষয় রোধের পাশাপাশি আয় বাড়াচ্ছেন কৃষকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা হতে পারে অ্যাগ্রো ইকো ট্যুরিজমের রোল মডেল। অ্যাগ্রো ইকো ট্যুরিজম এমন একটি পর্যটন মডেল যেখানে কৃষি, পরিবেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে পর্যটন পরিচালিত হয়। এতে বনাঞ্চল সংরক্ষণ, জৈব কৃষি চর্চা এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রচার হবে- যা টেকসই উন্নয়নের সহায়ক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ফল বাগান, হস্তশিল্প ও সংস্কৃতিকে পর্যটনের অংশ করে তুলতে পারেন। এতে তারা শুধু আয়ই করবেন না, বরং নিজেদের ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষায়ও ভূমিকা রাখতে পারবেন। পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয় ফলের পরিচিতি বাড়লে দেশের বাইরেও এর চাহিদা তৈরি হতে পারে। এতে রফতানির সুযোগ বাড়বে এবং কৃষকদের আয়ও বৃদ্ধি পাবে।

সরকারি সহায়তা ও প্রকল্প : ফলচাষকে সম্প্রসারিত ও টেকসই করতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে একাধিক প্রকল্প। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) ‘ফল উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ এখন পার্বত্য জেলাগুলোতে সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ, সেচ ও সারের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এম এম শাহ্ নেয়াজ নয়া দিগন্তকে বলেন, চলতি বছর ডিএইয়ের সহায়তায় প্রায় দুই হাজার কৃষক আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ফলচাষের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। একই সাথে পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের জাত উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণেও বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রাসেল আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছি উচ্চফলনশীল জাতের চারা লাগাতে। অনেক কৃষক এখন বারি মালটা-১, ড্রাগন ফল ও বিদেশী জাতের কমলা চাষে সফল হচ্ছেন।’

উৎপাদন বাড়লেও সমস্যা আছে বাজারে : যদিও উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু পার্বত্য এলাকার ফলচাষিরা এখনো বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা সমস্যার মুখোমুখি। দুর্গম এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় অনেক সময় ফল পচে যায় বা ন্যায্যমূল্য পান না কৃষকরা। রাঙামাটির জুরাছড়ি এলাকার চাষি তারুং মারমা বলেন, ‘আমার লিচু ঢাকা নিয়ে গেলে কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়, কিন্তু এখান থেকে ব্যবসায়ীরা ৬০-৭০ টাকায় কিনে নেয়। আমাদের এখানে হিমাগার নেই, ফলে বেশি দিন ফল রাখা যায় না।’

বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের প্রকল্প প্ররিচালক আব্দুল হালিম বলেন পাহাড়ি ফল এখন শুধু দেশের বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও রফতানির সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু ড্রাগন ফল, আনারস ও আম সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানো হয়েছে। পাহাড়ি এলাকার ফল চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে অর্গানিক পদ্ধতি ও কম রাসায়নিক। এই চাষাবাদ পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদে মাটি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, পাহাড়ি অঞ্চলে ফল চাষের সম্প্রসারণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ি অঞ্চলের ফল বিদেশে রফতানির জন্য মান নিয়ন্ত্রণ, গ্রেডিং ও প্যাকেজিং সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাবনা বিবেচনায় আছে। ভবিষ্যতে এখানকার ফল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।

কৃষিতে বৈচিত্র্য আনতে এবং আয়ের নতুন পথ খুলতে পাহাড়ি অঞ্চলে চাষ হচ্ছে কফি ও কাজুবাদাম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এগুলো বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এ প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু এ দুই ফসলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। প্রকল্পের শুরুর দিকে যেখানে দেশে কাজুবাদামের চাষ হতো মাত্র এক হাজার ৮০০ হেক্টরে, সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২০০ হেক্টরে। কফির ক্ষেত্রেও একই চিত্র মাত্র ৬৫ হেক্টর থেকে বেড়ে এক হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও পরিকল্পনা : বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উপযুক্ত নীতিমালা ও অবকাঠামোগত সহায়তা পেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের মোট ফল উৎপাদনের ২০ শতাংশেরও বেশি সরবরাহ করতে পারবে। বর্তমানে এই অঞ্চলের ফল উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪.৫ লাখ মেট্রিক টন। আগামী পাঁচ বছরে তা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন শুধু আরো বিনিয়োগ, সড়ক ও পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা এবং রফতানির সুযোগ সৃষ্টি।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ি জনপদে ফলচাষ এখন শুধু কৃষির অংশ নয়, এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন, নারী ক্ষমতায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের অংশ হয়ে উঠেছে। এই সাফল্যের গল্প আরো বিস্তৃত করার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও বাজার সংযোগ। যদি তা নিশ্চিত করা যায়, তবে ভবিষ্যতে ‘ফলের রাজধানী’ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম উচ্চারিত হবে বলে তারা মনে করেন।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *