গাজায় তীব্র গরমও কি ইসরায়েলের ‘অস্ত্র’

Google Alert – সশস্ত্র

ইউরোপজুড়ে তাপপ্রবাহের মধ্যে ইতালি চার দেয়ালের বাইরে খোলা জায়গায় কাজকর্মে বিধিনিষেধ দিয়েছে, ফ্রান্স বন্ধ করেছে স্কুল, কীভাবে শরীর আর্দ্র রাখতে হবে, সেই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আর ভূমধ্যসাগর তীরের গাজায় তীব্র গরমে কী করছে সেখানকার বাস্তুচ্যুত মানুষ?

ইসরায়েলের আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজার একজন পদার্থবিদ ও লেখক কাসেম ওয়ালিদ এই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এই গ্রীষ্মকে ফিলিস্তিনের এ ছিটমহলের মানুষকে হত্যার ‘হাতিয়ার’ করেছে ইসরায়েল।

এর আগে ক্ষুধাকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। এখন ত্রাণকে ‘হাতিয়ার’ করার অভিযোগ ওঠেছে।

আল জাজিরায় কাসেম ওয়ালিদ লিখেছেন, পারদ চড়তে থাকায় গাজা উন্মুক্ত এক ‘চুল্লিতে’ পরিণত হয়েছে। গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো ন্যূনতম কোনো সুবিধা আর অবশিষ্ট নেই। অথচ সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইউরোপের লোকজনকে ঘরে থাকতে, শরীর আর্দ্র রাখতে, বাইরে বেরোলেও ভারী কোনো কাজ না করতে এবং ত্বকের যত্নে সানস্ক্রিন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু গাজার মানুষের ঠাঁই নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই, পানি নেই, পালানোর পথও নেই।

ওয়ালিদ লিখেছেন, গাজার মানুষের ঘরে থাকার উপায় নেই, কারণ খাবার, পানি, জ্বালানি- সবকিছুর জন্যই বাইরে যেতে হচ্ছে। আর শরীরের পানিশূন্যতা দূর করবে? গাজার মানুষের সেই উপায়ও নেই। পানিই এখানে দুষ্প্রাপ্য, সীমিত পরিমাণ বরাদ্দের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা প্রায়ই পানের অযোগ্য। আর সানস্ক্রিন, সেটা বরং ‘মঙ্গল গ্রহে’ খুঁজে পাওয়া যাবে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে ঢুকে হামলা ও জিম্মি করার পাল্টায় গাজায় আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। গত প্রায় ২২ মাসে গাজায় ৫৭ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যাকে গণহত্যা হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

ওয়ালিদ লিখেছেন, “পুরো গাজা প্রায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। মাটিকে পরিণত করেছে ধূলায়।”

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ ‘পরিকল্পিতভাবে’ গাজায় হাজার হাজার ভবন বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, ভিডিও যাচাই করে এমন তথ্য দিয়েছে বিবিসি।

চলতি বছরের মার্চ মাসে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েল ফের গাজায় হামলা চালানোর পর থেকে তারা এই ভবন ধ্বংস শুরু করেছে।

পুরো শহর ও শহরতলী গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল, এক সময় যে এলাকাগুলোতে ছিল শত-সহস্র মানুষের বাড়ি। গত কয়েক সপ্তাহে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিবিসি ভেরিফাইয়ের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ধ্বংস ছিল বেশিরভাগই পূর্বপরিকল্পিত এবং অনেক ভবন তখনও ব্যবহার উপযোগী ছিল।

জুলাই মাসে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ রাফাহ নগরীর ধ্বংসাবশেষের উপর একটি ‘মানবিক শহর’ গড়ার রূপরেখা প্রকাশ করেছিলেন।

সেখানে প্রাথমিকভাবে ছয় লাখ ফিলিস্তিনিকে রাখা, পরে আরও ফিলিস্তিনিকে সেখানে ঢোকানো এবং তারপর তাদেরকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন তিনি।

তবে এই পরিকল্পনার ব্যাপক নিন্দা জানান খোদ ইসরায়েলেরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট। তিনি এই পরিকল্পনাকে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করেন।’


আগ্রাসনের আগে গাজার গ্রীষ্মের দিনগুলোর বর্ণনা দিয়ে ওয়ালিদ বলেছেন, তখন সৈকত ছিল উন্মুক্ত, যেখানে মানুষ উপভোগ করতো। বাড়ির আঙিনার বাগান ও গাছের ছায়া মৃদু বাতাসে মানুষ স্বস্তি পেত।

কিন্তু গাজার উদ্যানগুলো পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে, শহরগুলো হয়ে গেছে গোরস্থান। গাজা এখন ছায়াহীন এক শহর।

ছবি: রয়টার্স

গ্রীষ্মের এই গরম নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে। এই তাপদাহ প্রাকৃতিক নয়, এরকম হয়ে ওঠার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও দায়ী নয়। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ইসরায়েল। অবিরাম বোমা বর্ষণে ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাস নির্গমন, ধূলার পুরো স্তর ও দূষণের কারণে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রাই এই তীব্র গরমের জন্য দায়ী। বোমা বিস্ফোরণ এখানে সেখানে আগুন ধরে যাচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণ করারও উপায় নেই। আবর্জনা পচছে খোলা আকাশের নিচে, খেতখামার ধ্বংস হয়ে গেছে। এক সময় যা ছিল জলবায়ু সংকট, এখন তা সামরিক বাহিনীর সৃষ্ট জলবায়ু ‘নৃশংসতা’ ‘।

গাজার এই পদার্থবিদ লিখেছেন, গরমের মধ্যেই তাকে পানির জন্য দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তার পর আবার খাবারের জন্য সারিতে অপেক্ষা করতে হয়। তার ভাষ্য, ক্ষুধার চেয়ে ‘সানস্ট্রোককে’ ভয় পান তিনি। রাতেও একই পরিস্থিতি।

গাজার অনেক মানুষে ঠাসা এখন সাগরতীর। সেখানে তাঁবু খাটিয়ে থাকছে তারা। তাঁবুও গরম ছড়াচ্ছে। মাটির মত সূর্যাস্তের পর ঠাণ্ডা হয় না।


গত গ্রীষ্মে তারা যখন গাজার পূর্বাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন, তখনও কয়েক পদের খাবার অন্তত ছিল। তখনও ত্রাণ মিলছিল, রান্না করা যেত। কিন্তু গত ২ মার্চ ইসরায়েলি বাহিনী যখন আবার ত্রাণ আটকে দিল, তখন তারা অনাহারে পড়লেন।

ওয়ালিদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) নামে এক অদ্ভূত নাটক মঞ্চস্থ করছে, যেখানে ময়দা বিতরণ করা হয়। অমর্যাদাকর অবস্থার মধ্যেও গুলি খেয়ে না মরলে আপনাকে খালি হাতে ফিরতে হতে পারে।

ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ কার্যক্রম ব্যবহার করে শত শত মানুষকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।

প্রতিদিনের ধুঁকে ধুঁকে মরার এমন ভয়ংকর চিত্র হাজির করে ওয়ালিদ লিখেছেন, “তারা আমাদের জীবনযাপনকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে। আমরা আর নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের কথা বলছি না। আমরা শুধু জানতে চাই, শেষ দিনটি পর্যন্ত যথেষ্ট খাবার পাবতো?”

তিনি বলছেন, ইসলায়েল সবকিছু করছে, যাতে গাজাবাসীর অস্তিত্ব মুছে যায়। খাবার ও পানি থেকে বঞ্চিত করা, গরমে আশ্রয়হীন করা। বিদ্যুৎ নেই, বিপণী বিতান নেই, ময়দা নেই, মাছ নেই, জ্বালানি- আশা করার মতো কিছু নেই নাগালে। অনেকের জন্য এই গ্রীস্ম হতে পারে শেষ গ্রীষ্ম।

তার ভাষায়, এটা কোনা জলবায়ু সংকটের ঘটনা নয়। এটা আবহাওয়া, যাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই যুদ্ধে বোমা, বুলেট নয় শুধু, গরম, তৃষ্ণা এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়াকে ‘অস্ত্র’ বানানো হয়েছে। গাজা কেবল জ্বলছে না, বরং মানুষের তৈরি সূর্যের নিচে দমবন্ধ হয়ে আসার অবস্থা হয়েছে। বিশ্ব তা তাকিয়ে দেখে, আর বলে ‘সংঘাত’। তারা নির্বিকার আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে।

পুরনো খবর:

গাজায় হাজার হাজার ভবন মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *