Google Alert – সশস্ত্র
বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার গহীন অরণ্যে দুই দল বন্দুকধারীর মধ্যে গোলাগুলিতে অন্তত চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে গোলাগুলির বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
“গত রাতে গুলি বিনিময়ের খবর আমরা শুনেছি। খবরটি সত্যি। তবে তাতে হতাহতের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি,” বলছিলেন তিনি।
জেলা পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েলও বলেছেন, সরকারের অন্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য এখনো তারা পাননি।
তবে ইউপিডিএফ-এর মুখপাত্র অংগ্যা মারমা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তাদের সংগঠন একটি গণতান্ত্রিক দল। “আমরা কারও সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নই। আমাদের কেউ নিহতও হয়নি। আমাদের নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।
যদিও স্থানীয়রা বলছেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শুক্রবার রাত আটটার পর নাড়াইছড়ির দুর্গম এলাকায় দীর্ঘসময় ধরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চার জনের মৃত্যুর খবর এলেও কোনো পক্ষই তা স্বীকার করেনি।
ছবির উৎস, Getty Images
ঘটনা সম্পর্কে কতটা জানা যাচ্ছে
দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সেটি উপজেলা সদর থেকে ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গহীন অরণ্যে, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের পক্ষে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করা কঠিন।
এটি ভারত সীমান্তের একেবারেই কাছে এবং ওই এলাকা দিয়ে পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে বলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য যে কোনো মূল্যে এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় বলে জানান স্থানীয়রা।
এই নিয়ন্ত্রণ রাখা নিয়েই ওই এলাকায় ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর দুটি সশস্ত্র অংশের মধ্যে গত কিছুদিন ধরেই সংঘাত-সংঘর্ষ হয়ে আসছে বলে স্থানীয়রা দাবি করছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার রাতে ইউপিডিএফ এবং জেএসএসের দুজন সামরিক কমান্ডারের নেতৃত্বাধীন দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। স্থানীয়দের দাবি, এতে যারা নিহত হয়েছে তারা ইউপিডিএফ এর সামরিক শাখা ‘গণমুক্তি ফৌজ’ বা পিপলস্ লিবারেশন আর্মির সদস্য।
তবে অংগ্যা মারমা বিবিসির সাথে আলাপকালে এমন দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার দাবি, তাদের এমন কোনো সামরিক শাখা নেই।
ইউপিডিএফ এর প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, তাদের চার সদস্যের নিহত হওয়ার খবর সত্যি নয়।
“উক্ত গোলাগুলির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কোনো তথ্য ইউপিডিএফের জানা নেই এবং ইউপিডিএফ একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে ‘গণমুক্তি ফৌজ’ বা ‘পিপলস্ লিবারেশন আর্মি’ নামে তার কোনো সামরিক শাখা থাকার প্রশ্ন একেবারে অবান্তর ও কাল্পনিক,” অংগ্যা মারমাকে উদ্ধৃত করে ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
ছবির উৎস, Getty Images
বিবৃতিতে বলা হয়, ইউপিডিএফ কারো সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নয় এবং তার কোনো সদস্য কোনো যুদ্ধে নিহত হয়নি।
“ইউপিডিএফের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে ও ভাইবোনছড়ায় ত্রিপুরা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এভাবে দুরভিসন্ধিমূলক মিথ্যা প্রচারে নেমেছে,” বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস এর দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস -এর মধ্যে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর এর বিরোধিতা করে গড়ে উঠেছিলো ইউপিডিএফ, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রসিত বিকাশ খিসা।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতার মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুন ঢাকায় এক কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়। সন্তু লারমার দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির সমিতি থেকে তরুণদের একটি অংশ বের হয়ে ইউপিডিএফ গঠন করে।
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনকারী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বা সন্তু লারমাকে কোণঠাসা করার জন্য বিশেষ গোষ্ঠীর সমর্থনে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়।
পরে পাহাড়ে ইউপিডিএফ যত বিস্তৃত হতে থাকে মি. লারমার প্রভাব-প্রতিপত্তি ততই কমতে থাকে।
পরবর্তীতে জেএসএস ও ইউপিডিএফ ভেঙে আরও উপদল তৈরি হয়ে এবং বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের নানা জায়গায় এসব দল-উপদল নানা ধরনের সহিংস তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে–– এমন অভিযোগ আছে।
ছবির উৎস, BBC BANGLA
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইউপিডিএফ ভেঙে যায়। তখন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আত্মপ্রকাশ করে।
অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি ভেঙে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে আগেই আরেকটি দল তৈরি হয়েছিল।
এরপর থেকেই পাহাড়ি এলাকায় এই চারটি গোষ্ঠীর মধ্যে অব্যাহত সংঘাত লেগেই রয়েছে। এদের মধ্যকার সংঘর্ষে গত সাত বছরে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
তবে পার্বত্য এলাকার তিনটি জেলা – রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবনে ইউপিডিএফ-এর জোরালো অবস্থান রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এর মধ্যে খাগড়াছড়িতেই ইউপিডিএফ-এর অবস্থান সবচেয়ে শক্তিশালী।
প্রসঙ্গত, পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন নামে যেসব গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্বের চেয়ে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদার ভাগবাটোয়ারা প্রধান বিষয় এবং সে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যই প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়রা মনে করেন।