ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতাই মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে

Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পারমাণবিক অস্ত্র একটি বড় প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান। এটি কেবল সামরিক শক্তির প্রতীক নয় বরং একটি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির মাধ্যমও। পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ কমে এসেছে, কারণ সকলেই জানে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ মানেই বিপর্যয়। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তির (এনপিটি) শর্ত অনুসারে মোট পাঁচটি রাষ্ট্র যথা- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং চীন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারি। পারমাণবিক অস্ত্রধারী অন্য রাষ্ট্র হল ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া।ইসরায়েলের কাছেও পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা আছে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তিগবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের মোট সংখ্যা ছিল ১৩,০৮০ এবং এসব অস্ত্রের নব্বই শতাংশেরও বেশি রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এই বোমা হামলায় প্রায় দুই লাখ মানুষ নিহত হয়।এটি ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র সামরিক ব্যবহার। এরপর থেকে কোনো যুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের আর কোন নজির নেই। বরং পারমাণবিক বোমাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রেখেছে।

পারমাণবিক অস্ত্রের ধারণাটি “পরস্পর নিশ্চিত ধ্বংস” (Mutually Assured Destruction – MAD) নামে পরিচিত একটি স্থিতিশীলতার নীতি তৈরি করে, যা রাশিয়া এবং আমেরিকা তথা সকল পারমানবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। কোনো দেশ যদি পারমাণবিক হামলা চালায়, তবে অন্য দেশটিও নিশ্চিতভাবে পাল্টা পারমাণবিক হামলা চালাবে, যার ফলে উভয় দেশের ব্যাপক ধ্বংস অনিবার্য। এই ভয়ের কারণে কোনো দেশই প্রথমে পারমাণবিক হামলা করার সাহস পায় না, যার ফলে একটি স্থিতিশীল অবস্থা বজায় থাকে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- Tit for tat (ঢিল মারলে পাটকেলটি খেতে হয়), বাংলায় বলা হয় যেমন কুকুর তেমন মুগুর কিংবা যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেতুল। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ কথাগুলো বা প্রবাদগুলো প্রযোজ্য এবং বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে প্রযোজ্য।

উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় রাশিয়া ও আমেরিকা উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্রধারী এবং উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আদর্শগত সংঘাত থাকায় তাদের মধ্যে অতীতে শীতল যুদ্ধ ছিল। উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি, প্রচার প্রচারণা এবং বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য কাজ করেছে। এছাড়াও, বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেমন- কোরিয়ান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং আফগানিস্তান যুদ্ধে, আমেরিকা ও রাশিয়া একে অপরের প্রতিপক্ষের সমর্থনে কাজ করেছে, যা প্রক্সিযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ দু’টি দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের কোন নজির নেই কারণ তারা পারমাণবিক অস্ত্রধারি হওয়ায় নিজেদের রক্ষায় কেউ কাউকে আক্রমণ করেনি। কোনো আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তারা প্রস্তুত থাকে। রাশিয়া ও আমেরিকা মাঝে মাঝে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি করে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা সীমিত করার চেষ্টা করে। এটি উত্তেজনা হ্রাস করতে এবং পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক সবসময় স্থিতিশীল থাকে না। মাঝে মাঝে উত্তেজনা দেখা দিলেও, পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে উভয় দেশই সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে ভয় পায়। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের মতে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরমাণু শক্তিধর দেশ, উভয়েই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগার আধুনিকীকরণ করছে। চীনও দ্রুত তার পারমাণবিক অস্ত্রাগার বাড়াচ্ছে কিন্তু চীন যে কোন সময় এবং যে কোন পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্রের No First Use (NFU), প্রথম ব্যবহার না করার নীতি অনুসরণ করে এবং অ-পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্য ইউএস ২০২২ নিউক্লিয়ার পশ্চার রিভিউতে বলা হয়েছে, রাশিয়া ও চীন উভয়ই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরি করছে, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘যুক্তরাষ্ট্রকে তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কৌশলগত প্রতিযোগী ও সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হিসেবে দুটি প্রধান পারমাণবিক শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। চীন ১৯৬৪ সালে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার পর থেকেই ঘোষণা দেয় যে, তারা কখনোই কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। এটি চীনের পারমাণবিক নীতির মূল স্তম্ভ। No First Use (NFU) বা ‘প্রথমে ব্যবহার না করার নীতি’। চীন এ নীতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম প্রভাবশালী বাস্তববাদী চিন্তাবিদ কেনেথ ওয়াল্টজ ২০১২ সালের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ লেখেন। এর শিরোনাম ছিল, ‘কেন ইরানকে বোমা পেতে দেওয়া উচিত’। বোমা মানে পারমাণবিক বোমা। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত ইরান মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল না করে বরং স্থিতিশীল করতে পারে। তার যুক্তি মূলত বাস্তববাদ এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রতিরোধের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ওয়াল্টজের মতে: মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচেটিয়া পারমাণবিক আধিপত্য আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণ। ইরান পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করলে ইসরায়েলের ক্ষমতায় তা একটা ভারসাম্য আনবে। যা একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত, যখন উভয় প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তখন পারস্পরিক ধ্বংসের যুক্তিসঙ্গত ভয় তাদের যুদ্ধ থেকে বিরত রাখে। ওয়াল্টজ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল ও ইরান উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর হলে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নিতে সতর্ক হবে। কেনেথ ওয়াল্টজ এর উক্তিটির যথার্থ প্রমাণ মেলে ইসরায়েল ২০২৫ সালের ১৩ জুন ইরানে আ্ক্রমণের পর ইরান যখন মাত্র ০১ দিনের ব্যবধানে ইসরায়েল এবং ২২ জুন/২০২৫ তারিখে কাতারে অবস্থিত আমেরিকান ঘাটিতে আক্রমন শুরু করে তখন ইসরায়েল ও আমেরিকা ২৫ জুন/২০২৫ তারিখে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করে।

ওয়াল্টজের এই যুক্তিগুলো তখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। অনেকে তার বিপক্ষে মত দেন এবং বলেন, এতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। ওয়াল্টজের তত্ত্ব অনুযায়ী, পারমাণবিক অস্ত্রই হলো চূড়ান্ত প্রতিরোধক। এবং নির্দিষ্ট শর্তাধীনে এর বিস্তার আসলে বৃহত্তর স্থিতিশীলতা বয়ে আনতে পারে। উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরুন: পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পর থেকে তাদের আচরণ তর্ক সাপেক্ষ হলেও অনেক হিসেবি এবং স্থিতাবস্থামুখী হয়ে উঠেছে। এটি ট্রাম্পকেও সে দেশের প্রধান কিম জং-উনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করেছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে প্রচলিত সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা থাকলেও পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা নেই। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে No First Use (NFU) ‘প্রথমে ব্যবহার নয়’ নীতি রয়েছে। সেখানে পাকিস্তান বলেছে- তারা ‘অস্তিত্বগত হুমকির’ সম্মুখীন হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। দুই দেশের পারমাণবিক যে নীতি তাতে বোঝা যায় কেউই পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িত হবে না। কিন্তু এক পক্ষের কাছে এরকম অস্ত্র থাকলে সেক্ষেত্রে হিসেবেটা অন্য রকম হতো। ভারতের কাছে ১৭২টি এবং পাকিস্তানের কাছে ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। ভারতের কৌশলগত জোটে রয়েছে ই’স’রায়েল, রাশিয়া ও ফ্রান্স। অন্যদিকে পাকিস্তানের রয়েছে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। আছে সীমিত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও। সকল দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়ায আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারসাম্য রয়েছে।

পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং পারমাণবিক যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি Treaty on the Non-Proliferation of Nuclear Weapons (NPT), যা পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোকে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখে এবং অন্যান্য দেশগুলোকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করা থেকে বিরত রাখে। এছাড়াও, পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি বা Comprehensive Nuclear-Test-Ban Treaty (CTBT). Treaty on the Prohibition of Nuclear Weapons (TPNW) বা পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করে। পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং মজুদ নিষিদ্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই চুক্তিগুলোতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) পারমাণবিক অস্ত্রের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যা পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যাতে মানুষ পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং পারমাণবিক যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই বিষয়ে আরও অনেক কাজ করতে হবে, বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোকে এই বিষয়ে আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *