‘বাচ্চারা বলছিল আঙ্কেল, আমি হাঁটতে পারছি না, আমাকে একটু কোলে নেন’

Google Alert – আর্মি

২১ জুলাই ২০২৫। দিয়াবাড়ি আর্মি ক্যাম্পের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্যাম্প কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহসিন হক চৌধুরী। সঙ্গে জনা কয়েক সহকর্মী। হঠাৎই ভবনের পেছন থেকে বিকট আওয়াজ। শব্দ শুনে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেননি। আর্মি ক্যাম্পের গেট থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্ব মাইলস্টোন স্কুলে তারা পৌঁছান দুই থেকে আড়াই মিনিটে।

২৭ জুলাই। ঘটনার ছয়দিন পর জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন কর্নেল তাহসিন। তিনি ও তার দুজন সহকর্মী আবারও যান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে।

গত ২১ জুলাই এই স্কুলের হায়দার আলী ভবনে আছড়ে পড়েছিল এফ-৭ যুদ্ধবিমান। সরকারি হিসাবে এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৫, মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে আরও বেশ কয়েকজন শিশু।

মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে পৌঁছে প্রথমেই কী দেখেছিলেন দুর্ঘটনায় প্রথম সাড়াদানকারী সেনাসদস্যের দলটি?

‘অবস্থাটা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে ন্যাপাম বোমা আক্রমণের পর মানুষের যে অবস্থা হয়েছিল, তেমন। বাচ্চাদের গায়ে কোনো কাপড় ছিল না, চামড়া ছিল না, সব পুড়ে গেছে। দু-হাত ছড়িয়ে তারা হাঁটছিল।’

‘ওখান থেকেই আমাদের সৈনিকেরা উদ্ধার কাজ শুরু করে। কাউকে অটোরিকশা, কাউকে ভ্যানে— যে যানবাহন পেয়েছে, যে হাসপাতালে পেরেছে বাচ্চাদের পৌঁছে দিয়েছে। যারা (আহত হয়নি এমন) বাবা-মাকে খুঁজে পাচ্ছিল না, চেষ্টা করেছি তাদের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। অথবা একটা নিরাপদ স্থানে রাখার। কারণ, বাচ্চারা আতঙ্কিত হয়ে কান্নাকাটি করছিল।’ বলছিলেন তাহসিন।

ক্যাম্পাসের মূল ফটক পেরিয়ে মাঠ বরাবর ইটের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে হাতের ডান দিকে হায়দার আলী ভবন। আড়াইতলা এ ভবনটিকে দেখতে এখন পোড়ো বাড়ি মনে হয়। আগুনের তীব্রতায় ভবনের ছাদে ঝুলতে থাকা ফ্যানগুলো পর্যন্ত গলে গেছে। দু-একটা পাখা ঝুলে আছে কোনো মতে।

লে. কর্নেল তাহসিন ভবনের সামনে একটি জায়গা দেখিয়ে বলেন, ‘এখানেই আমরা প্রথম মরদেহ দেখতে পাই। একজন ছাত্রের। ওর মাথার কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। খুবই হৃদয়বিদারক, কষ্টদায়ক। সঙ্গে সঙ্গে একজন সৈনিক তার ইউনিফর্ম খুলে মরদেহ ঢেকে দেন।’

আরও পড়ুন

কয়েক পা এগিয়ে আবার থামেন তাহসিন। ‘এখানেও একটি মরদেহ ছিল। একজন অভিভাবকের। সেটাও ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিল। একইভাবে আরেকজন সৈনিক তার ইউনিফর্ম দিয়ে ওই মরদেহটা ঢেকে দেন। তার মাথার একটি অংশ ছিল না।’

‘বাচ্চারা বলছিল আঙ্কেল, আমি হাঁটতে পারছি না, আমাকে একটু কোলে নেন’

এখন পর্যন্ত তাহসিন মূল ঘটনাস্থলের একটু বাইরের বিবরণ দিচ্ছিলেন। এবার তিনি হায়দার আলী ভবনের যেখানে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল ঠিক সেই জায়গায় যান। বারবারই বলছিলেন, এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যাতীত। মর্মস্পর্শী।

ভবনের সামনে যুদ্ধবিমানের একটি পাখা ছিল ওপরের দিকে, আরেকটা নিচে। বিমানের মূল কাঠামোটি ঢুকেছে সিঁড়িঘরের পাশের শ্রেণিকক্ষে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। প্রচণ্ড উত্তাপ। ভেতরে বাচ্চারা পুড়ছে। বাইরে অভিভাবকদের আকুল আর্তনাদ।

‘আমরা অগ্নিনির্বাপক দিয়ে ছোট ছোট আগুনের কুণ্ডলিগুলো নেভানোর চেষ্টা করছিলাম। স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, অভিভাবক— যে যেভাবে পেরেছেন উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছেন।’

১৫ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। মোটামুটি একই সময়ে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার এসে পৌঁছায়। পুলিশ, র্যাব, বিমানবাহিনীও একে একে যোগ দেয়। কিন্তু ততক্ষণে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু শিশু।

‘তখনও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই ভবনের পেছনের জানালায় যাই। দেখলাম বেশ কিছু মরদেহ পুড়ে চেয়ার-টেবিলের ওপর পড়ে আছে।’

‘আপনারা বিভিন্ন ভিডিওতে দেখেছেন হাতুড়ি দিয়ে আমাদের সৈনিকরা গ্রিল ভাঙছে। কারণ, ওখানে গ্রিলের ভেতরে ছোট ছোট বাচ্চা পুড়ে ভস্ম হয়ে টেবিলের ওপর পড়ে ছিল। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ওদের উদ্ধার করতে। আগুনের তাপ, গ্যাস, ধোঁয়া—সবকিছু উপেক্ষা করে যেভাবে সম্ভব হয়েছে আমরা পেছনের দিক থেকে মরদেহগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। আমরা যা দেখেছি তা খুবই মর্মস্পর্শী।’

‘বাচ্চারা বলছিল আঙ্কেল, আমি হাঁটতে পারছি না, আমাকে একটু কোলে নেন’

প্রথমত, ওরা তো পুড়েই গেছে, ভেতরে আগুন জ্বলতে থাকায় পোড়া শরীরগুলো আরও পুড়তে থাকে। সামনের দিক থেকে উদ্ধার করাদের তো আমরা আগেই সরিয়ে ফেলি… বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল ট্রিটমেন্টের জন্য।’

‘গ্রিলের পেছনের ওই মরদেহগুলো… বাচ্চাগুলো টেবিলের ওপরে বসা… হাতগুলো টেবিলের ওপরে… তাদের মাথাটা টেবিলের ওপরে নোয়ানো… তাদের শরীরগুলো ঝলসে গেছে… খুলিগুলো পুড়ে অনেকটা কাগজের মতো গুঁড়া গুঁড়া হয়ে গেছে।’

‘চোখে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু জানালার গ্রিল এবং আগুন—এসবের কারণে সেখানে পৌঁছাতে পারছিলাম না। দেখতে পারছিলাম, তখনও ভেতরে আগুন জ্বলছে। এর চেয়ে মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা আমার মনে হয় আর কিছু হতে পারে না। মানুষের শরীর পুড়তে দেখা সবচেয়ে মর্মস্পর্শী দৃশ্য। এটা ভীষণ কঠিন…,’ এক নাগাড়ে বলে যান লে. কর্নেল তাহসিন।

সামনের দিকে কিছু শিশু বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, যন্ত্রণায় জ্বলতে জ্বলতে, কোনো রকমে। ‘অনেক বাচ্চা কান্না করছিল। কিছু ছোট ছোট বাচ্চা সামনে এগিয়ে এসে বলছিল ‘আঙ্কেল, আমি হাঁটতে পারছি না। আমাকে একটু কোলে নেন।’

একটু থেমে তিনি আবার বলেন, ‘একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে পৌঁছে দেওয়ার সময় গলা জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল। কিছু বাচ্চা একটু পানির জন্য, একটু সাহায্য পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিল। তাদের গায়ের চামড়াগুলো… পুড়ে যাওয়া মানুষের চামড়া, যখন ধরা হচ্ছিল… শরীরের রক্ত আমাদের হাতে উঠে আসছিল। এটা ছিল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী বিষয়।’

আরেকটা শিশুকে কোলে নেওয়ার পরে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে নেয়। সে আর চোখ খোলে না। ছোট্ট একটা বাচ্চা…। এর বেশি আমি বর্ণনা করতে পারছি না,’ বলেই ক্যামেরা থেকে মুখ সরিয়ে নেন এই সেনা কর্মকর্তা।

জেপিআই/এএসএ/এমএফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *