রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণে হামিদ কারজাই থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

Google Alert – ইউনূস

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট। তালেবানদের হাতে পতন ঘটে আফগান সরকারের, যার নেতৃত্বে ছিলেন হামিদ কারজাইয়ের উত্তরসূরি আশরাফ ঘানি। তার পতনে ধসে পড়ে দুই দশক ধরে ১৪৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পশ্চিমাদের আধুনিক আফগান রাষ্ট্রগঠনের অভিপ্রায়। এ পতন কেবল একটি সরকারের নয়, বরং রাষ্ট্রগঠনের দৃষ্টিভঙ্গিরও। পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত তিনটি সংকট যে পতনের মূল কারণ। প্রথমত, আফগানিস্তানের সমাজ ও রাজনীতির ঐতিহ্যগত বংশানুক্রমিক, ধর্মনির্ভর ও ঔপজাতিক কাঠামো কখনই আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বিদেশী মদদে গড়ে ওঠা সরকার কখনই দেশজ একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। আফগান ভূখণ্ডে ছড়িয়ে থাকা বহু ক্ষমতার কেন্দ্র নিজ নিজ বলয়ে স্বাধীন ছিল। আর তৃতীয়ত, গভীর ধর্মবিশ্বাসে আস্থাশীল একটি সমাজে ‘বাইরের দুনিয়া’ থেকে আমদানি করা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা গড়ে ওঠেনি। যে কারণে আধুনিক রাষ্ট্রগঠন প্রচেষ্টার নড়বড়ে ভিত্তি সময়ের প্রবল ঝাঁকুনিতে টিকতে পারেনি।

আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আফগানিস্তানের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল অমিত সম্ভাবনায়। কিন্তু ইতিহাস তার পথে বিছিয়ে দিয়েছিল অগণিত কাঁটা। বিশ শতকের গোড়ায় বাদশাহ আমানউল্লাহ খানের নেতৃত্বে প্রথম যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, তা ভেঙে পড়ে সমাজ-সংস্কৃতির বাধায়। পরবর্তী শাসকরা তার রাষ্ট্রগঠনের কর্মসূচি পরিত্যাগ করে আবার ফিরে যান পরোক্ষ শাসন ব্যবস্থায়। যেখানে ধর্মীয় নেতা ও উপজাতীয় প্রধানরা হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রের ছায়াশাসক।

১৯৭৮ সালে ‘সাওর বিপ্লব’ বা এপ্রিল রেভল্যুশন নামে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আফগান কমিউনিস্টরা। তারা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর সাহায্যে আফগানিস্তানকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত সমর্থিত সেই প্রয়াসও মুখ থুবড়ে পড়ে বিদ্রোহ আর গৃহযুদ্ধে। এ পর্যায়ে তালেবানদের সমর্থনে ছিল পশ্চিমা শক্তি। আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত যুদ্ধগুলো আফগানিস্তানের গ্রামীণ অর্থনীতি ও সীমিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করে দেয়। এমন বিধ্বস্ত প্রেক্ষাপটে পশ্চিমাদের আদর্শিক রাষ্ট্রগঠনের চেষ্টা ছিল মরুভূমিতে জলসিঞ্চনের মতো।

২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর ২০০২ সালে হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় তাদের হাতে না ছিল কোনো সেনাবাহিনী, না প্রশাসন, না পুলিশ। মার্কিন কূটনীতিকদের ভাষ্যমতে দেশের বহু মানুষ ‘কেন্দ্রীয় সরকারের কেন প্রয়োজন’—এ বোধই রাখে না। তাদের বোঝাতে হতো সরকার তাদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি শক্তির ব্যবহার, আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা, পুলিশ ইউনিফর্মের ছায়া—সবই ছিল তাদের সংস্কৃতির বাইরে।

এ দূরত্ব শুধু মানসিক নয়, ছিল পারিপার্শ্বিকও। অক্ষরজ্ঞানহীনতায় ডুবে থাকা একটি জনগোষ্ঠী, যেখানে ৮০-৯০ শতাংশ সেনাসদস্য ছিলেন লিখতে-পড়তে অক্ষম (সূত্র: দ্য ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি)। এমন জনগোষ্ঠী নিয়ে একটি পশ্চিমা ধাঁচের সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিল এক ধরনের বিভ্রম। এ পরিস্থিতিকে আরো ঘনীভূত করে তোলে একটি কঠিন বাস্তবতা—আধুনিক রাষ্ট্রগঠনে প্রয়োজনীয় একক কর্তৃত্ব কখনই প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি কারজাই সরকার। এমনকি ২০০৪ সালে নির্বাচনে হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে ছিল না। যুদ্ধ-বিদ্রোহ ছিল প্রতিদিনের বাস্তবতা। ফলে একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে রাষ্ট্রগঠনের দ্বৈত ভার কাঁধে নিয়ে হোঁচট খেতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে ছিল দুর্নীতির কালো ছায়া। পেন্টাগনের তিন হাজার চুক্তির (যেগুলোর মোট মূল্য ১০৬ বিলিয়ন ডলার) মূল্যায়নে দেখা যায় যে এগুলোর ১৮ শতাংশ গিয়েছিল বিদ্রোহীদের হাতে এবং ১৫ শতাংশ সরকারঘনিষ্ঠ দুর্বৃত্তদের পকেটে।

আধুনিক আফগান রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থাকে একটি রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে বৈধতা দেয়া। মধ্য যুগ থেকে শুরু করে রেনেসাঁ, প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার, বৈজ্ঞানিক ও শিল্প বিপ্লব, পুঁজিবাদের মতো ধারাবাহিক বৃদ্ধিবৃত্তিক ও বস্তুগত পরিবর্তনের প্রভাবে ইউরোপের সমাজ ধাপে ধাপে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থানে পৌঁছে। কিন্তু আফগানিস্তানে কি সে রকম কোনো প্রেক্ষাপট ছিল? এককথায় উত্তর ‘না’। ইউরোপের মানবকেন্দ্রিক রাষ্ট্রদর্শন আফগান সমাজে এক অপসংযোগ হিসেবে দেখা দেয়। ইউরোপের মানুষের মতো ‘ধর্ম থেকে আলগা’ হওয়ার যাত্রা আফগান সমাজে কখনো শুরুই হয়নি।

এ বাস্তবতায় আধুনিক আফগান রাষ্ট্রগঠনের চেষ্টা ছিল যেন এক আত্মবিরোধী প্রকল্প। সমাজের গভীরে থাকা বিশ্বাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শ এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দেয়াল তুলে দাঁড়ায়। একটি কাঠামো নির্মাণের নামে সমাজকে অতিক্রম করতে গিয়ে সে সমাজের আত্মাকে বুঝতে ব্যর্থ হওয়াতেই আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রগঠনের প্রয়াস ভেস্তে যায়। যখন কোনো রাষ্ট্রকাঠামো জনগণের মৌল বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল আফগানিস্তানে। যে সরকার গড়ে উঠেছিল পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতায়, তার প্রতি বিশ্বাস জন্মেনি জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে। বরং ওই সরকার এমনকি তার আমলা, শিক্ষা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকেও আফগানরা পশ্চিমা আধিপত্যের বাহক বলে মনে করেছে। বলা যায় সংস্কার বা আধুনিকতার নাম করে চাপিয়ে দেয়া কাঠামো মুখ থুবড়ে পড়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সমাজের গভীরতর আত্মপরিচয়ের সামনে। যে কারণে আফগানিস্তানে ‘মেড ইন আমেরিকা’ রাষ্ট্রগঠনের প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের সমর্থনে আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণ প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা। ৩৬ দিনের আন্দোলনে প্রাণ হারান বিপুলসংখ্যক শ্রমিক, তরুণ, নারী ও সাধারণ নাগরিক, এমনকি শিশুও। আহত হন অগণিত মানুষ। দলীয় পেটোয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে নির্বিচারে অসংখ্য মানুষ হত্যার পর অবশেষে পরাজয় মেনে নিয়ে ৫ আগস্ট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর তিনদিন পর দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের গ্রহণযোগ্যতা ও বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তিনি নতুন বাংলাদেশ তথা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন।

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম সফর ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাষ্ট্র যান। সফরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। সাক্ষাতে বাইডেন স্পষ্ট করে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে তার আস্থা রয়েছে। ড. ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে প্রস্তুত।’ ড. ইউনূস দীর্ঘকাল ধরেই পশ্চিমা বলয়ের অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি মার্কিন কংগ্রেস থেকে পেয়েছেন কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল, যা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান। এছাড়া বারাক ওবামা প্রশাসন তাকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম প্রদান করেছিল। যা আমেরিকান সমাজে অসাধারণ অবদান রাখা ব্যক্তিদের দেয়া হয়। ড. ইউনূস সেই হাতেগোনা বিদেশী নাগরিকদের একজন, যিনি এই দুটি মর্যাদাপূর্ণ পদকে ভূষিত হয়েছেন। কেবল তা-ই নয়, আমেরিকার রাজনীতিতে প্রভাবশালী ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গেও তার সম্পর্ক বহু পুরনো ও ঘনিষ্ঠ। বিল ক্লিনটন প্রকাশ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে ‘একুশ শতকের অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

ড. ইউনূস কেবল যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিত নন। ইউরোপের বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধান ও ইউরোপীয় শক্তিবলয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি, জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল, এমনকি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গেও ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম থেকে শুরু করে ইউরোপীয় কমিশনের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিভিন্ন ফোরামে তিনি একাধিকবার ‘কৌশলগত উপদেষ্টা’ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) বাংলাদেশ ‘রিসেট বাটন’ পুশ করেছে বলে মন্তব্য করেন। নিউইয়র্কের হিলটন হোটেলে ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি অনুষ্ঠানে (২৪ সেপ্টেম্বর) বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের রূপান্তরকে ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’ বলে উল্লেখ করেন। যা ওই সময় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

কিন্তু কার্যকর রাষ্ট্রগঠনের সবচেয়ে মৌলিক ও জরুরি শর্তের একটি হলো সরকারের আইনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন বা রুল অব ল প্রতিষ্ঠা। আফগানিস্তানে যেটার বড় ঘাটতি ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১১ মাসে বাংলাদেশেও যে ঘাটতি দৃশ্যমান। সমাজে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত না হলে, জননিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা না হলে জনগণের আস্থা বিনষ্ট হয়। এ অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার পরিণতিতে রাষ্ট্রের প্রাথমিক ও আবশ্যিক জনসেবা যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধসে পড়ে। যদি জননিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা না পায় এবং জনসেবামূলক খাতগুলো যথাযথভাবে কার্যকর না হয়, তবে রাষ্ট্র পুনর্গঠন শুধু কাগজ-কলমেই থেকে যায়। রাষ্ট্রগঠনের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় যখন প্রশাসন বা সরকার সার্বিক জনকল্যাণের বদলে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে সাধারণ নাগরিক নিজেকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা উঠে যায়। রাষ্ট্র যদি জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক পরিচয় বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিতে তার আচরণ নির্ধারণ করে, তবে নাগরিকের আস্থার জায়গাটি ক্ষয়ে যেতে থাকে, যা একসময় রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের প্রয়াসকে স্তব্ধ করে দেয়।

রাষ্ট্র পুনর্গঠনে একটি মৌলিক দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি ভিত্তিতে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের ‘টপ-ডাউন’ নীতিনির্ধারণ পদ্ধতি, যা সমাজের বাস্তবতা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। অনেক সময় একটি নতুন বা পরিবর্তিত সরকার দ্রুত সংস্কার আনতে গিয়ে এমন নীতি গ্রহণ করে যেগুলো স্থানীয় বাস্তবতা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক কাঠামো কিংবা জনগণের জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেখানে সমাজের সব শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব থাকে না। ফলে নীতি কার্যকারিতা হারায়, জনগণ তা আত্মীকরণ করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপকে অনেক সময় জনগণ দেখে ‘উপর থেকে চাপানো’ একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। এ ধরনের নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত থাকে ‘লোকাল ওনারশিপ’—কিংবা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বা জনগণের অংশগ্রহণ ও নিজস্বতার স্বীকৃতি। এতে রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রয়াসের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের স্বপ্ন কেবল উচ্চস্তরের নথিপত্রেই থেকে যায় (ইউনাইটেড নেশন ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ মেকিং স্টেট ওয়ার্ক: ফ্রম স্টেট ফেইলিউর টু স্টেট বিল্ডিং)। একটি রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো টিকে থাকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সম্পদ বণ্টনের ওপর। যখন বাজার ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়, কিংবা সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সেখানে থাকে না তখন বাস্তবে বাজারের বড় অংশটি চলে কর্তৃত্ববাদী বিশেষ স্বার্থের ছায়ায়।

রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পথে সহিংসতা ও বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা একটি ভয়াবহ সংকেত। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থান, সরকার পরিবর্তন বা রাজনৈতিক রূপান্তরের পর নতুন নেতৃত্বের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা দুর্বল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বহিঃপ্রকাশ। এমন পরিস্থিতিতে শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি যদি হয় উদাসীন অথবা এমন সহিংসতা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়, তবে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া অন্য পথে বাঁক নেয়। একটি কার্যকর রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলো সংঘাত নিউট্রালাইজ করা, যাতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা প্রশাসনিক নীতি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা আবেগতাড়িত জনতার দ্বারা প্রতিস্থাপিত না হয়। এর ব্যত্যয় হলে তা কার্যত রাষ্ট্রের ভেঙে পড়ার পূর্বাভাস।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সংকটকালে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা যাচাই একটি কঠিন পর্ব। এ সময় মানুষ সরাসরি রাষ্ট্রকে দেখতে চায় তাদের পাশে। কিন্তু যদি সেখানে রাষ্ট্রের উপস্থিতি থাকে সীমিত বা অনুপস্থিত, তখনই প্রকট হয়ে ওঠে কাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রশাসনিক অকার্যকারিতা। এ ধরনের ব্যর্থতা সরাসরি রাষ্ট্রের উপস্থিতির প্রশ্ন তোলে। দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রাষ্ট্রের কাজ হলো জনগণের প্রয়োজনে কিংবা সংকটে দ্রুত সাড়া দেয়া কিন্তু যদি দেখা যায় সেখানে রাষ্ট্রের উপস্থিতি নেই তাহলে নাগরিকদের মধ্যে ‘স্টেট এলিয়েনেশন’ তৈরি হয়।

রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সফলতার অন্যতম নির্ণায়ক হলো বিচার ব্যবস্থার ভারসাম্য এবং এর অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটি সুসংহত সমন্বয়। এক্ষেত্রে দুয়েকটি বিচারে পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার চেয়ে বিচার ব্যবস্থার ভারসাম্যের রূপান্তর বেশি জরুরি। তা না হলে রাষ্ট্রের কাঠামোগত দুর্বলতা বা গভীরতর সংকটগুলো দূর হয় না। রাষ্ট্রগঠনে প্রয়োজন একটি ব্যবস্থাগত রূপান্তর, অতীতে বিচার বিভাগের রাজনৈতিক ব্যবহার, কিংবা ক্ষমতাসীনদের রক্ষা করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও জনমুখী বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। (ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত ২০১০ সালের নীতিপত্র ‘ফেইলড বাই ডিজাইন? দ্য লিমিটেশন অব স্টেট বিল্ডিং’)।

ইতিহাসে দেখা যায়, গণ-অভ্যুত্থান পরিবর্তনের সূচনা করে ঠিকই, কিন্তু তার পরবর্তী পথ নির্ভর করে নতুন নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি, রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার ও সামাজিক ঐক্যের ওপর। এমন অভ্যুত্থানের পর একেকটি রাষ্ট্র একেকভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়েছে—কেউ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কেউ ঘুরপাক খেয়েছে সংকটের আবর্তে।

সিঙ্গাপুর একসময় দুর্বল অর্থনীতি, দাঙ্গা ও বেকারত্বে জর্জরিত একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ছিল। স্বাধীনতার পরপরই সেখানে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, জাতিগত বিভাজন চরমে পৌঁছে যায়। কিন্তু লি কুয়ানের কঠোর নেতৃত্বে দেশটি খাদের কিনারা থেকে উঠে আসে। আইনের শাসন, শিক্ষার বিস্তার এবং আমলাতন্ত্রে দক্ষতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে দেশটি পরিণত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিতে। দেশটির নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। গণ-আন্দোলনের পর লি দায়িত্বশীল ও শৃঙ্খলাবদ্ধ রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় মন দেন। যেখানে বাজার, শিক্ষা, শিল্প—সবকিছুতে রাষ্ট্রের কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।

আবার দক্ষিণ আফ্রিকার কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে বর্ণবাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের (অ্যান্টি অ্যাপারথেইড মুভমেন্ট) বিজয়ের পর দেশটি প্রতিহিংসার পথে না হেঁটে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করে। তারা গুরুত্ব দেয় সত্য প্রকাশ ও সামাজিক পুনর্মিলনের ওপর। এর মাধ্যমে তারা ভয়ংকর এক বিভাজন ও সহিংসতার অতীত পেরিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে সফল হয়।

শ্রীলংকা মাত্র দুই বছর আগে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। জ্বালানি ঘাটতি, খাদ্যাভাব, ঋণখেলাপি, মূল্যস্ফীতির লাগামছাড়া গতি এবং দুর্নীতির প্রতিবাদে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পড়েন গোতাবায়া রাজাপাকসে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে জনরোষ, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামে, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল হয়। জনরোষের মুখে গোতাবায়া দেশ ছেড়ে পালান। লক্ষণীয় হলো এ পরিবর্তন ছিল শান্তিপূর্ণ। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশগুলোয় সাধারণত দেখা যায় দাঙ্গা, লুটপাট, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, প্রতিশোধপরায়ণ নীতি। এগুলোর কোনোটিই শ্রীলংকায় ছিল না। সরকার পতনের পর সবাই ফিরে যান নিজের কাজে। এ পরিবর্তনের মধ্য থেকেই উঠে এসেছেন বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা আনুরা কুমারা দিশানায়েকে। ২০২২ সালের জুনে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি ছিল ৭০ শতাংশের বেশি, সেখানে গত জুনে দেশটির সার্বিক মূল্যস্ফীতি মাইনাস শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ অর্থাৎ ঋণাত্মক স্তরে নেমে আসে (সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকা)। শুধু অর্থনীতি নয়, শ্রীলংকায় বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনেও কোনো বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে না। রাজাপাকসে পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে যেসব তদন্ত ও বিচার চলছে, তা নিরপেক্ষভাবে অগ্রসর হচ্ছে। একসময় সহিংসতায় জর্জরিত দেশটিতে এখন বড় রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখছে, যা কোনো রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সবচেয়ে বড় পুঁজি।

বিপরীতে স্মরণ করা যায় তিউনিসিয়ার চিত্র। আরব বসন্তের সূতিকাগার এ দেশের জনগণ ২০১১ সালে জাইন এল-আবেদিন বেন আলির শাসনের অবসান ঘটায় গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। প্রথমদিকে এ উত্তাল পরিবর্তন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি করলেও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অনৈক্য, সহিংসতা, সাংবিধানিক জটিলতা দেশটিকে আবার অস্থিরতার গহ্বরে ফেলে। ইসলামপন্থী এননাহদা পার্টি ও ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে অনেক সংস্কার ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদ কার্যত একচ্ছত্র শাসন কায়েম করেন। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হয়ে তিউনিসিয়ায় আবারো কর্তৃত্ববাদী শাসনের ছায়া নেমে এসেছে।

রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক জটিল বহুপথের সম্মুখে। সরকারকে বুঝতে হবে কোথায় ভারসাম্য, কোথায় জনসম্পৃক্ততা, কোথায় সহিষ্ণুতা আর কোথায় দৃঢ়তা জরুরি। কার্যকর ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রগঠনের জন্য যে বিষয়টি জরুরি হয়ে ওঠে তা হলো অগ্রাধিকার নির্ধারণ। রাষ্ট্র যদি জানে তার কোন দায়িত্বটি মৌলিক, কোনটি জরুরি কিংবা তাৎক্ষণিক তাহলে পথচলা অনেকটাই সুসংহত হয়। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন অগ্রাধিকারভিত্তিক স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ—যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মপরিকল্পনার প্রতিটি ধাপ সময়ের বাস্তবতা ও নাগরিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাজানো হবে। লক্ষ্যগুলোকে শুধু ঘোষণায় রেখে দেয়া নয়, বরং প্রতিটি বড় লক্ষ্যকে ছোট ছোট বাস্তবভিত্তিক ধাপে ভাগ করে ফেলা জরুরি, যেন প্রতিটি পর্যায়ে অগ্রগতি মাপা যায়, প্রয়োজনে গতি বাড়ানো যায়। লক্ষ্য পূরণে নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা আবশ্যক। প্রতিটি ধাপ যেন হয়ে ওঠে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি। আর এই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা হচ্ছে—তা ট্র্যাক করতে হবে নিয়মিত। এতে জানা যাবে রাষ্ট্র পুনর্গঠন কোথায় দাঁড়িয়ে, আর কোন পথে এগোচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি ইউনিট, প্রতিটি স্তরকে সমন্বিত পরিকল্পনায় শৃঙ্খলার সঙ্গে অংশ নিতে হবে; যার প্রতিটি পদক্ষেপ হবে পূর্বপরিকল্পিত, পরিমিত, ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত।

গণ-অভ্যুত্থান যত বিশালই হোক না কেন, যদি তার পরবর্তী রাষ্ট্রীয় অভিযাত্রা সংকটে পতিত হয় তাহলে নতুন রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন আটকে যায় অনিশ্চিত গোলকধাঁধায়। যে গোলকধাঁধায় আটকে গিয়েছিল তিউনিসিয়া কিংবা কারজাই সরকার। যদিও ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার হামিদ কারজাইয়ের মতো আরোপিত নয়, বরং ক্ষমতায় এসেছেন গণ-অভ্যুত্থানে জাগরিত জনগণের প্রত্যাশা নিয়ে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ড. ইউনূস ক্ষমতায় এলেন তা কেবল পালাবদল নয় বরং নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের অনন্য ঐতিহাসিক সুযোগ। কিন্তু তিনিও আজ ইতিহাসের সে অস্থিরতার চক্রে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে নেতৃত্বের দৃঢ়তায় কোনো কোনো দেশ উঠে এসেছে দৃপ্ত ভোরের দিকে, আবার কেউ পড়ে রয়েছে সংকটের ঘূর্ণিপাকে।

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: সম্পাদক, বণিক বার্তা

[অনুলিখন ও সহায়তায় মাহফুজ রাহমান]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *