Google Alert – আর্মি
মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার আলী ভবনটি আড়াইতলা। নিচতলার বড় অংশই মাটি ভরাটের পর নিচে চলে গেছে। ফলে ক্লাস হয় আসলে দেড় ও আড়াই তলায়। ভবনে ঢোকার মুখে বড় গ্রিলের দরজা।
২১ জুলাই যখন যুদ্ধবিমান ভবনে আছড়ে পড়ে, তখন আগুন এই গ্রিলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছায়।
সেদিন উদ্ধার কাজে নেতৃত্ব দেওয়া দিয়াবাড়ি আর্মি ক্যাম্পের প্রধান ক্যাম্প কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহসিন হক চৌধুরী বলেন, এই পথ বাদ রেখে শিশুদের বের করে আনা ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে বাচ্চাকে উদ্ধার করতে চাওয়া অভিভাবককে বোঝানোও ছিল কঠিন কাজ।
প্রথম পর্ব: উদ্ধারকারী সেনা কর্মকর্তা/‘বাচ্চারা বলছিল আঙ্কেল, আমি হাঁটতে পারছি না, আমাকে একটু কোলে নেন’
গত ২৭ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দাঁড়িয়ে তাহসিন বলছিলেন, সেদিন উদ্ধারকাজ পরিচালনায় কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন তারা।
আগের পর্বেই জেনেছেন, সেদিনকার পরিস্থিতি ছিল ভিয়েতনামে ন্যাপাম বোমা বিস্ফোরণের পরের মতো। ভেতরে আটকা পড়া দগ্ধ শিশুদের বেরোনোর নিষ্ফল চেষ্টা, বেরিয়ে আসা শিশুদের হাসপাতালে পাঠানো, আকুল অভিভাবকদের ঘটনাস্থল থেকে সরানো, নইলে প্রাণহানি আরও বাড়ার আশঙ্কা, আর উৎসুক জনতার ভিড়। সবশেষে শিশুদের মরদেহ গুমের অভিযোগ ও তা থেকে সৃষ্ট বিক্ষোভ তো ছিলই।
‘গ্রিলের ওই দরজা ছাড়া ভবন থেকে বেরোনোর পথ ছিল না। আমাদের সেটা বানাতে হয়েছে। এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ,’ লে. কর্নেল তাহসিন জাগো নিউজকে বলেন।
এদিকে আগুনের তাপ এতটা তীব্র যে চারপাশের লোহাজাতীয় যা কিছু আছে সব গলে যাচ্ছিল। ঝাঁঝালো ধোঁয়া উদ্ধারকারীদের শ্বাসনালিতেও ঢুকছিল, নিশ্বাস নেওয়াই কঠিন। ভেতরে আটকা পড়া শিশুদের অবস্থা তখন আরও করুণ।
আসলে সেনাসদস্যরা এসেছিলেন কোনো প্রস্তুতি ছাড়া খালি হাতে। কারণ বিস্ফোরণের শব্দ শুনে তারা আর কালবিলম্ব করেননি।
‘কিছুক্ষণ পরেই কয়েকটি হাতুড়িসহ সরঞ্জাম হাতে পাই আমরা,’ বলেন তিনি।
‘ধোঁয়া ও তাপের মতো বিষয়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে সৈনিকরা নিজেদের ইউনিফর্ম খুলে সেটা ভিজিয়ে মুখে বেঁধে বা পানি ঢেলে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। কেউ কেউ নিজের ইউনিফর্ম খুলে ভিজিয়ে মুখে বেঁধেছেন, কেউ বা পানি ঢেলে ধোঁয়ার দাপট ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।’
১৫ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এরপর একে একে যুক্ত হন পুলিশ, র্যাব, বিমানবাহিনীর সদস্যরাও। শিক্ষার্থী, শিক্ষক-অভিভাবকরাও হাত লাগান।
তখনও আগুন নেভেনি, শরীরে আগুন নিয়ে বাচ্চারা বের হচ্ছে, বিমানটি দ্বিতীয় বিস্ফোরণের আশঙ্কা—এমন ‘দুঃসহ’ পরিবেশের মধ্যে আরেক দুশ্চিন্তা তৈরি হয়—মানুষের ভিড়।
লে. কর্নেল তাহসিনের ভাষায়, দুই ধরনের মানুষ তখন সেখানে, একদল যারা সন্তানদের খোঁজে এসেছে। তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক, কান্না। তারা কিছুতেই থামতে চান না। অনেকে আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েই বাচ্চা উদ্ধার করতে চান।
‘তাদের বোঝাতে হয়েছে—দয়া করে একটু ধৈর্য ধরুন। আমরা চেষ্টা করছি বের করে আনার, কারণ, তারা যদি নিজেরাও আহত হন বা আগুনে পুড়ে যান, ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে,’ বলেন তিনি।
‘অন্যদিকে ছিল উৎসুক জনতা—যারা ভিডিও করতে এসেছেন। সমস্যা হলো, স্কুলে প্রবেশের জন্য একটি মাত্র রাস্তা। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস—সবই ওই পথ দিয়েই আসছে। আর সেই পথ ভিড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। দগ্ধদের অনেককে কাঁধে তুলে কয়েকশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে নিতে হয়েছে। তার মধ্যে দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণের আশঙ্কাও ছিল,’ বলেন সেনা কর্মকর্তা তাহসিন।
এর মধ্যেই আরও এক চাপে পড়ে উদ্ধারকারী দল। হেলিকপ্টার নামাতে হবে। কিন্তু মাঠজুড়ে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ। কেউ নড়ছেন না। বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীর আরেকটি দল মোতায়েন করে জনতাকে সরানোর চেষ্টা করতে হয়।
তাহসিন বলেন, ‘হেলিকপ্টার ল্যান্ড করাটা ছিল অত্যন্ত জরুরি। আমরা ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই উদ্ধারকারী প্রথম হেলিকপ্টারটি দেখতে পাই।’
দুর্ঘটনার প্রথম ৩০ মিনিট অত্যন্ত কঠিন ছিল বলে উল্লেখ করেন লে. কর্নেল তাহসিন। ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা, দগ্ধদের উদ্ধার করা, ভিড় সামলানো– তিনটি কাজ একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল খুবই কঠিন,’ বলেন তিনি।
হায়দার আলী ভবনের সামনে বিশাল মাঠ। মাঠের এক প্রান্তে স্কুলের আরেকটি বহুতল ভবন। ক্যাপ্টেন তাহসিনের ধারণা, বিমানটি ওই ভবনের গা ঘেঁষে নিচে নেমে মাঠের এ পাশে হায়দার আলী ভবনের নিচতলা বরাবর আঘাত করে।
পোড়া ভবনটি দেখিয়ে তাহসিন বলেন, ‘ভবনটির চারপাশ গ্রিল দিয়ে ঘেরা। একটি প্রান্তের গ্রিল ভেঙে শিশুদের বের হওয়ার রাস্তা তৈরি করতে তারা সক্ষম হন।
ভবনটির পেছনে গ্যারেজের লোহার গেট পরে তারা খুলে ফেলেন। সেটি দোতলা বরাবর বসিয়ে বাচ্চাদের ‘স্লাইড’ করে নামানো হয়।
উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ২০০ জন সেনাসদস্য। তার মধ্যে প্রায় ২৫ জন আহত হন। ‘ধোঁয়ার মধ্যে যেসব গ্যাস তৈরি হয়—কার্বন মনোঅক্সাইড, ডাইঅক্সাইড—সেগুলো ইনহেল করেই আমাদের অনেক সহকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন,’ বলেন দলের কমান্ডার তাহসিন।
পাইলট উদ্ধার
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর পাইলট কোথায় গেলেন, সেটা তখনো স্পষ্ট ছিল না। পরে জানা যায়, তিনি ইজেক্ট করেছিলেন।
তাহসিন হক চৌধুরী বলেন, পাইলট বিমানটি ক্র্যাশ করার আগেই ইজেক্ট করেন, এটাই বাস্তব সত্য কথা। আনুমানিক ২০-২৫ মিনিট পর, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৫০ গজ দূরে একটি টিনশেড ভবনে তাকে পাওয়া যায়।
স্কুলের একটি টিনশেডের ভবনে টিন ভেঙে ভিতরে ঢুকে যান তিনি। অন্য একটি উদ্ধারকারী দল তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। তিনি বেশ আহত ছিলেন। প্যারাশুটটা দেখা যাচ্ছিল।
‘ততক্ষণে স্কুলে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সেখানকার ডাক্তার তার পালস চেক করে তাকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করে সিএমএইচে নিয়ে যান,’ জানান তাহসিন।
তবে উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার পরও আলোচনার শেষ নেই। কে কী করেছে, কে কী করেনি—নানান কথা উঠেছে। সে প্রসঙ্গে ক্যাম্প কমান্ডার স্পষ্ট করে বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নিহত ও আহতদের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। আমরা বা তারা, কেউ কোনো অভিযোগ পাইনি। যারা বলছেন, তারা কোথা থেকে কী বলছেন, আমরা জানি না।’
এই অভিযোগ সেনাবাহিনীকে ব্যথিত করে কি না জানতে চাইলে তাহসিন বলেন, ‘আমরা বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছি। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই কাজ করছি। আমাদের পেশাদারত্ব বা দায়িত্ববোধে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
‘যে কোনো দুর্যোগে, যে কোনো সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের পাশে ছিল, থাকবে। কোনো অবস্থায়ই আমাদের দায়িত্ব পালনে ঘাটতি হবে না,’ বলেন তিনি।
চারদিকে মৃত্যু, পোড়া মানুষের চিৎকার, বাঁচার বা বাঁচানোর আর্তনাদ—এমন পরিস্থিতিতে সেনা সদস্যরা কীভাবে নিজেদের সামলেছিল জানতে চাইলে লে. কর্নেল তাহসিন বলেন, পেশাদারত্ব, পেশাদারত্ব এবং পেশাদারত্ব।
‘সেসময় সবাই আবেগাপ্লুত ছিল। অত্যন্ত দুর্বিষহ একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এর মধ্যে পেশাদারত্ব ছাড়া এমন পরিস্থিতিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এছাড়া আমরা উদ্ধার কাজ পরিচালনাই করতে পারতাম না।’
দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী পৌঁছে যাওয়ায় হতাহত বাড়তে পারেনি বলে মনে করেন তাহসিন।
জেপিআই/এএসএ/এমএফএ/এএসএম