পার্বত্য এলাকায় অশান্ত পরিবেশের অন্তরালে

Google Alert – কুকি চিন

পার্বত্য এলাকায় অশান্ত পরিবেশের অন্তরালে

ছবি: সময়ের আলো

দীর্ঘকাল ধরে চট্টগ্রামে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে প্রতিবেশী দেশ। অজ্ঞাত কারণে বিগত সরকারের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সেনা চৌকিগুলো উঠিয়ে নিলে সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। সবচয়ে ভয়ংকর খবর হচ্ছে, এই উগ্রবাদী পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়িদের সঙ্গে মিশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য লোকালয়ে চলে যাচ্ছে। এতে করে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক তৈরি হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি স্থানে গুম, খুন, চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনায় পাহাড়ি এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে এবং এতে করে মানুষ খুনের ঘটনাও সংঘটিত হয়েছে। কয়েক দিন পরপর পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের শান্ত পরিবেশ অশান্ত করার চেষ্টা করছে। এতে কলকাঠি নাড়ছে দেশি-বিদেশি শক্তি। দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য এলাকাকে অশান্ত করার জন্য দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো উসকানি দিচ্ছে। এর মধ্যে আগুনে ঘি ডালার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি স্থানীয় উপজাতি-উগ্রবাদী সংগঠনগুলো।

স্থানীয় উপজাতি সংগঠনের সদস্যরা এবং পার্বত্য এলাকার দেশি-বিদেশি স্বাধীনতাকামী উগ্রবাদী সংগঠনগুলো মিলে যৌথভাবে কলকাঠি নাড়াচ্ছে। এর মাধ্যমে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যার জন্য পাহাড়ি এলাকায় জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় পাহাড়ি বাঙালিরা পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি জানান। পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাতিলসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে ইউপিডিএফ, জেএসএস, কেএনএফ। গত ১২ মে ২০২৫ এক প্রতিবাদ সমাবেশে আঞ্চলিক দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সব সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ। বক্তারা অভিযোগ করেন, ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ‘তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব’ দাবির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। অবিলম্বে ইউপিডিএফকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে দ্রুত নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। দলটির অন্যতম নেতা মাইকেল চাকমা, যার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তার দল ইউপিডিএফ পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা কাজে জড়িত। পাহাড়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। সেই সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সমাবেশ থেকে আরও দাবি জানানো হয়-দেশদ্রোহী মাইকেল চাকমা, সন্তু লারমা, প্রসীত খীসা, প্রকৃত রঞ্জন চাকমা, দেবাশীষ রায়, ইয়েন ইয়েনসহ পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সব গডফাদারকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এ সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় সংঘাত-সংঘর্ষও হয়েছে।

গত ২০ জুলাই খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজিবি ও  ইউপিডিএফের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পরে অভিযান চালিয়ে কয়েক ধরনের অস্ত্র, গুলি ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করে বিজিবি। চলতি বছরের ১৫, ২১, ২৩ জানুয়ারি ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় নানা রকম অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এর মধ্যে রয়েছে মরণঘাতী অস্ত্র, বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র এবং লকেট লঞ্চার, গ্রেনেড, একে-৪৭, ম্যাগাজিন, এম-৪ কার্বাইন, ৪০ এমএম গ্রেনেড লঞ্চার, চায়না রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল, এসএলআর, এসএমজি, এলজি, বিমান বিধ্বংসী রিমোট কন্ট্রোল বোমা, গ্রেনেড, হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল। এসব অত্যাধুনিক প্রাণঘাতী অস্ত্রের মজুদ রয়েছে দেশের তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে থাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে। এসব অস্ত্রের জন্য খাগড়াছড়ির মণিপুরের তারাবন এলাকায় রয়েছে অস্ত্রগুদাম। খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণ আর আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব অস্ত্র। অশান্ত হয়ে উঠছে পাহাড়। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের মজুদ, চাঁদাবাজি আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসীরা এখন স্বপ্ন দেখছে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার।

তিন পার্বত্য জেলায় কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমে জানা যায়, তাদের দাবি-দাওয়ার পেছনে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের অন্তর্নিহিত ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্র যোগ করে কল্পিত জুম্মল্যান্ডের মানচিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। তারা জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপের রয়েছে আর্ম ক্যাডার ও সেমি আর্ম ক্যাডার বাহিনী। এর মধ্যে আর্ম ক্যাডারের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। অন্যদিকে সেমি আর্ম ক্যাডারের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। সেমি আর্ম ক্যাডাররা অস্ত্রে প্রশিক্ষিত। তারা ভবিষ্যতে সংগঠনগুলোর জন্য কাজে লাগে। এসব সন্ত্রাসীর কাছে কয়েক হাজার আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।

ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের (কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) জন্য তৈরি করা ২০ হাজার ৩০০ পিস ইউনিফর্ম জব্দ করেছে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কেএনএফ নামে যে সংগঠনটির জন্য এসব ইউনিফর্ম বা পোশাক তৈরি করা হচ্ছিল সেই সংগঠনটি একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। তিন বছর আগে ফেসবুক পেজ খুলে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এটি। এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। পাহাড়ের দুই জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে একটি আলাদা রাজ্য গঠনের ঘোষণাও দেয় তারা। আল-শারক্বিয়া নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার খবরও বের হয়। কেএনএফ বা কুকি চিন দুই-তিন বছর ধরে পাহাড়ে এক আতঙ্কের নাম। তারা সশস্ত্র অবস্থান করে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়, হত্যা, অপহরণ, গুম, গরু-মহিষ ও ক্ষেতের ফসল লুট এবং ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। বড় বড় বেশ কয়েকটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে অবৈধভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। কেএনএফের সদস্যরা পাহাড়ি নৃ-সংগঠন ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সহায়তায় লোকালয়ে যাতায়াত ও দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের জন্য হাটবাজারে প্রবেশ করছে।

দীর্ঘকাল ধরে চট্টগ্রামে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে প্রতিবেশী দেশ। অজ্ঞাত কারণে বিগত সরকারের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সেনা চৌকিগুলো উঠিয়ে নিলে সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। সবচয়ে ভয়ংকর খবর হচ্ছে, এই উগ্রবাদী পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পাহাড়িদের সঙ্গে মিশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য লোকালয়ে চলে যাচ্ছে। এতে করে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক তৈরি হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।

এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে পাহাড়ি কৃষকরা জুম চাষ, গাছ বাগান পরিচর্যা, কৃষি খামার, মৎস্য ও গরু-মহিষের খামার এবং ফলের বাগান পরিচর্যার জন্য পাহাড়ে যেতে পারছে না। সাধারণ মানুষ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবনযাপন করছে। এমতাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবিলম্বে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে পাহাড়ি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।

পার্বত্য এলাকা নিয়ে বিদেশিরা দীর্ঘদিন ধরে একটি খ্রিস্টান রাজ্য বানানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব দাবির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে বার্মার আরাকান আর্মিকে করিডর দেওয়ার ভয়াবহ চিন্তা আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ হবে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট গুণিজন।

এমএইচ

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *