Google Alert – সেনাবাহিনী
চট্টগ্রামে স্নিগ্ধ ও নৈসর্গিক পরিবেশে শায়িত আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো ৭৫১ সেনা। ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটি ‘চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি’ নামে পরিচিত। নগরীর বাদশা মিয়া রোডে অবস্থিত এই যুদ্ধসমাধি যেন উঁচু-নিচু স্থানে বিছানো এক সবুজ গালিচা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এ সিমেট্রি তৈরি করেছে। এখানে শায়িত রয়েছেন দেশের জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেওয়া ১০ দেশের বীর সৈনিকরা। প্রতিটি সমাধির গায়ে লেখা আছে শহীদদের নাম-পরিচয়। কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন কর্তৃক পরিচালিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ স্মারক দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করেন দর্শনার্থীরা।
সরেজমিন নগরীর চকবাজার থানাধীন বাদশা মিয়া রোডে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে গ্রিলের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা রয়েছে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি। বড় বড় গাছে ঘেরা সুনসান নীরবতা বিরাজ করে পুরো সমাধিস্থল। প্রবেশের সময় হাতের বাম দিকে রয়েছে একটি সাইনবোর্ড। সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা রক্ষায় সেখানে লেখা রয়েছে বেশ কিছু নিয়মকানুন। প্রবেশ পথের ডান পাশে ছোট একটি কক্ষে সংরক্ষিত রেজিস্টারে ১৯৩৯-৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সাগরে মৃত্যুবরণ করা নাবিক ও লস্করদের নাম লেখা রয়েছে। পুরো সমাধিস্থলে রয়েছে দেবদারু, গর্জন, মেহগনি, ইউক্যালিপটাস, পামসহ ৪০ প্রজাতির গাছ। এছাড়া গন্ধরাজ, বেলী, পাতাবাহার, লেনথানা, গোলাপ, লেটারলিফসহ শতাধিক দেশি-বিদেশি ফুলগাছ সমাধিতে এক অসাধারণ মোহের সৃষ্টি করেছে। অতি যত্নে সংরক্ষিত সমাধির সারি দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। তাই ইতিহাস জানতে প্রতিদিন নগরীর এবং চট্টগ্রামের আশপাশের মানুষ ভিড় করেন এই সমাধিস্থলে। চট্টগ্রামে যুদ্ধ না হলেও কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিস্থল নির্মিত হয়েছিল-এমন প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খায়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং ১৫২ নং ব্রিটিশ জেনারেল হাসপাতালের সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র বাহিনী চতুর্দশ সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। হাসপাতালটি ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৪৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চালু ছিল। সেসময় এই ক্যাম্পে প্রচুর সৈন্যকে আহত অবস্থা থেকে সুস্থ করে দেশে পাঠানো হয়েছিল। আর যারা সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, তাদের সম্মানার্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি দল চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রি বা সমাধিসৌধ প্রতিষ্ঠা করে। পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে এই সমাধি নির্মাণ করা হয়।
কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের ওয়েবসাইট সূত্র জানায়, ১৯৩৯-৪৫ সালের যুদ্ধের ৭৩১টি কমনওয়েলথ সমাধি রয়েছে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে। যার মধ্যে ১৭টি অজ্ঞাত। এছাড়া আরও ২০টি বিদেশি সমাধি রয়েছে। এরমধ্যে ১ জন ডাচ নৌবাহিনীর নাবিক এবং ১৯ জন জাপানি সৈন্যের সমাধি রয়েছে। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে ৭৫৫টি সমাধি রয়েছে। এরমধ্যে ৭৫১টি যুদ্ধকালীন। বাকি চারটি অন্য সময়ের। এখানে শায়িত যোদ্ধাদের মধ্যে ৫৪৩ জন সৈনিক, ১৯৪ বৈমানিক এবং ১৪ জন নাবিক রয়েছেন। এটি কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন কর্তৃক পরিচালিত। কমিশন নিহত প্রতিটি সদস্যের তথ্য সংরক্ষণ করে, যা তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে দেখা যায়। স্যার ফেবিয়ান ওয়্যার নামে ব্রিটিশ রেড ক্রসের এক কর্মকর্তার নিরলস চেষ্টার ফসল এ কমিশন। এই কমিশনের প্রধান কার্যালয় লন্ডনে অবস্থিত। সেখান থেকেই ওয়ার সিমেট্রিগুলো দেখভাল করা হয়। কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের অনুদানে চলে এ সংস্থাটি।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪০০ বীর সৈনিককে সমাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে অতিরিক্ত মৃতদেহ ঢাকা, খুলনা, যশোর, কক্সবাজারের ধোয়া পালং, দোহাজারি, রাঙামাটি, পটিয়া এবং অন্যান্য অস্থায়ী সমাধিস্থান থেকে এই সমাধিস্থানে স্থানান্তর করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত নাগরিকদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৭৮ জন, কানাডার ২৫ জন, অস্ট্রেলিয়ার ৯ জন, নিউজিল্যান্ডের ২ জন, অবিভক্ত ভারতের (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) ২১৪ জন, পূর্ব আফ্রিকার ১১ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৯০ জন, মিয়ানমারের ২ জন, নেদারল্যান্ডসের ১ জন ও জাপানের ১৯ জনের সমাধি রয়েছে। ইউনিট আর পদবির ব্যবধান ঘুচিয়ে একই আকার-আকৃতির সমাধিফলকে রয়েছে প্রত্যেকের নাম, রেজিমেন্ট ও দেশের নাম। পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু সমাধি-ফলকে নিহত সদস্যের পরিবারের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে পবিত্র কোরআনের আয়াত, বাইবেল থেকে নেওয়া বাণী অথবা প্রিয় কবিতার পঙ্ক্তিমালা সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকাল ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত থাকে। এছাড়া শীতকালীন ও রোজার সময় কিছুটা সময়ের পরিবর্তন ঘটে থাকে। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, বৃষ্টি ও রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে ওয়ার সিমেট্রি বন্ধ থাকে।
শুক্রবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে ওয়ার সিমেট্রি দেখতে যাওয়া মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এই স্থানটি চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম মনোরম এবং মনোমুগ্ধকর স্থান হিসাবে পরিচিত। তবে বৃষ্টির কারণে বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। অনেকেই বিষয়টি না জানায় সেখানে গিয়ে ফিরে চলে গেছে।’